X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

একাত্তরের স্মৃতি

তসলিমা নাসরিন
২০ মার্চ ২০১৬, ১৪:৩২আপডেট : ২০ মার্চ ২০১৬, ১৪:৫৭

তসলিমা নাসরিনগত ১৭ মার্চে পেঙ্গুইন ইণ্ডিয়ার আয়োজনে একটা আলোচনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। বিষয় ছিল পাকিস্তান কার চোখে কী রকম। প্রাক্তন মন্ত্রী শশী থারুর ছিলেন, আরও বাঘা বাঘা বক্তা ছিলেন। আমিও ছিলাম বক্তাদের একজন, তবে স্বল্পভাষী এবং অবশ্যই মৃদুভাষী। পাকিস্তানিদের প্রথম কখন দেখি, এরকম প্রশ্নের উত্তরে বলেছি, একাত্তরে যুদ্ধের সময়, যখন পাকিস্তানী সেনারা আমাদের বাড়ি লুঠ করতে এসেছিল, বাবাকে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়েছিল, বেয়নেটের আঘাতে বাবার শরীর রক্তাক্ত করেছিল, আমাদের সব টাকাপয়সা সোনা রূপো নিয়ে গিয়েছিল। আমাকেও হয়তো নিয়ে যেতো ক্যাম্পে, ধর্ষণ করতো মাসের পর মাস, বাধ্য করতো আত্মহত্যা করতে, কিন্তু বয়স আমার অল্প বলে আমাকে তুলে নিয়ে যায়নি। ঘুমের ভান করে পড়েছিলাম সে রাতে। এখনও দুঃস্বপ্নের মতো একাত্তরের সেই মধ্যরাত।
অন্য বক্তারা ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো করতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বললেন। এর মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান প্রদানকে মূল্য দিলেন সকলে। তা ঠিক। একই সঙ্গে, আমি মনে করি, পাকিস্তানকে আরও একটি জরুরি কাজ করতে হবে, রাষ্ট্র আর ধর্মকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে। ধর্মকে রাষ্ট্রের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলে রাষ্ট্র একদিন না একদিন মৌলবাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়, সভ্য রাষ্ট্রে নয়।
সে রাতে মধ্যরাতে পাকিস্তানি আর্মিরা ঢুকেছিল বাড়িতে। কী করছিলাম আমি?
---‘ছটকু, আমার ছোট মামা, সেরাতে  মড়ার মতো ঘুমিয়েছিল। মাথায় বালিশ পড়তেই ছটকুর ঘুম এসে যায়। ও না ঘুমোলে নির্ঘাত চেঁচাত, আর ওরা ঠিক গুলি করে মারত ওকে, কেবল ওকে কেন, যারা ঘুমিয়ে ছিলাম ও বিছানায়– আমাকে, আমার ছোট বোন ইয়াসমিনকে, সবাইকে মারত। আমি অবশ্য ঘুমোইনি, ঘুমের ভান করে পড়েছিলাম, যেন ঘুমের মধ্যে আমি তখন ঘুমরাজ্যের ঘুমপরীর সঙ্গে খেলা করছি, দোলনা দুলছি, যেন আমি আর মানুষের দেশে নেই, যেন আমি কিছুই টের পাচ্ছি না ঘরে অনেকগুলো বুট পরা লোক হাঁটছে, কাঁধে তাদের বন্দুক, তারা যে কোনও সময় হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে ইয়ার্কি করতে করতে গুলি করে মারতে পারে যে কাউকে, কেউ ঘুমিয়ে নেই জানলেই তার খুলি উড়ে যাবে গুলিতে, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে ক্যাম্পে, ক্যাম্পে নিয়ে চাবকে চাবকে বেয়নেটের গুঁতোয় গুঁতোয় হাড়গোড় গুঁড়ো করা হবে। বুট পরা লোক যা খুশি করুক, তুমি ঘুমিয়ে থাকো মেয়ে, তোমার চোখের পাতা যেন না নড়ে, তোমার গা হাত পা কিছু যেন না নড়ে, হাতের কোনও আঙুল যেন না নড়ে, তোমার বুক যেন না কাঁপে, যদি কাঁপেই যেন বুকের কাঁপন ওরা, যখন মশারি তুলে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, টর্চের আলো ফেলবে তোমার ওপর, তোমার মুখে, তোমার বুকে, তোমার উরুতে, চোখ থেকে লালা গড়াবে, জিভ বেয়ে আগুন ঝরবে আর কথা বলবে এমন ভাষায় যা তুমি বোঝ না, টের না পায়। টের না পায় তোমার এক ফোঁটা অস্তিত্ব, টের না পায় তুমি আছ, তুমি জেগে আছ, যদিও তুমি আছ, জেগে আছ। যদি পায়ই টের, তবে যেন ওরা বলতে বলতে চলে যায়, তুমি কিশোরী হওনি, যুবতী হওনি, এখনও তোমার স্তন বলতে কিছু নেই। 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
নামাজ চলাকালে মসজিদের এসি বিস্ফোরণ, মুসল্লিদের মধ্যে আতঙ্ক
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ