ভারত নয়, চীনই বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় বন্ধু

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এখন সবচেয়ে বড় বন্ধু চীন বলে মনে করছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে চীন সহযোগিতা করতে যাচ্ছে, এর আশপাশেও নেই প্রতিবেশী ভারত। চীন এমন সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে, যখন জঙ্গি ইস্যুসহ নানা অজুহাতে অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। শুক্রবার বাংলাদেশ ও চীনের সরকার ও দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যেসব চুক্তি হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে চীন।

এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ শনিবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চীন সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ বাংলাদেশে করতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা সরকারি-বেসরকারি অনেকগুলো চুক্তি করেছে। শুধু বেসরকারি খাতেই তারা বিনিয়োগ করবে ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ। এছাড়া সরকারি পর্যায়ে আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার জন্য তারা চুক্তি করেছে।’ তিনি বলেন, ‘চীন প্রমাণ করে দিলো যে, বাংলাদেশ বিনিয়োগের নিরাপদ স্থান।’

এফবিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, ‘যে সব দেশ জঙ্গি ইস্যুসহ নানা অজুহাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত রয়েছে, তাদের চোখ খুলে দিলো চীন। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য ভারতও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের বিশাল বিশাল কোম্পানি আমাদের দেশে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু ভারতের ক্যাপাসিটি চীনের মতো নয়। এ কারণে চীনের মতো ভারত এদেশে বিনিয়োগ করতে পারবে না।’ তিনি বলেন, শুক্রবার চীনের ১৫টি কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই হয়েছে। চীনের ১৫টি কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের ১৫টি কোম্পানির মধ্যে ১৯টি চুক্তি হয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চীন সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সঙ্গেও চুক্তি করেছে। এই সব চুক্তি বাস্তবায়িত হলে দেশে সরাসরি বিনিয়োগ বাড়বে। চীনের অন্য যেসব বিনিয়োগকারী দেশ এখনও আসেনি, সেসব দেশও এই দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে। চীনের বাইরে ভারতসহ অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারীও আসবে। এর ফলে দেশে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশে যদি চীন বিনিয়োগ করতে পারে, তাহলে অন্যরা কেন পারবে না? চীনের এই উদাহরণ অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারী উৎসাহিত করবে। তবে এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হলো—এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের জন্য যে ধরনের অবকাঠামো দরকার, তা আমাদের নেই। এ কারণে দ্রুত অবকাঠামো প্রস্তুত করা জরুরি। বিশেষ করে যে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে, সেটি দ্রুত রেডি করা, অন্যান্য অঞ্চলেও অবকাঠামো প্রস্তুত রাখা।’ তিনি বলেন, ‘দেশের অবকাঠামো পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি করা গেলে ভারতও এদেশে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবে।’ ভারতের জন্য আমাদের যে দু’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হয়েছে সে ‍দু’টিতে দ্রুত অবকাঠামো রেডি করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ভারত অতি সম্প্রতি যে ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি করেছে, সে সব প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়িত হলে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও দেশে বিনিয়োগ করতে শুরু করবেন।’

প্রসঙ্গত, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ঢাকা এসেছিল চীনের ৮৬ সদস্যের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে উভয় দেশের প্রতিনিধি দলের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উপকূলীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়ন ও সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ ও চীন। এর মধ্যে ১২টি ঋণ ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি এবং উভয় দেশের সরকারের মধ্যে ১৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক।

এর মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগ ও উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা চুক্তি, যার আওতায় ২৮টি উন্নয়ন প্রকল্পে ২১.৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি সাহায্যের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া আট কোটি ৩০ লাখ ডলার অনুদানের জন্য অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা চুক্তি, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে ৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি, দাশের কান্দি পয়ঃনিষ্কাশন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রকল্পের জন্য ২৮ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি এবং ছয়টি জাহাজ সম্পর্কিত মোট চারটি ঋণচুক্তি। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ ও দাশেরকান্দিতে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণেও দুটি কাঠামো চুক্তি হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। এর বাইরে চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগে সহযোগিতা, মেরিটাইম কো-অপারেশন, মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাই, আইসিটিতে নতুন ফ্রেমওয়ার্ক, সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতা, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ও তথ্য আদান-প্রদান, জলবায়ু পরিবতর্নের ঝুঁকি মোকাবিলা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতার লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাবে, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। চীন এই এলাকার অর্থনৈতিক বৃহৎ শক্তি। এছাড়া এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রেও চীন খুবই গুরুত্ব পূর্ণ।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অন্য যেকোনও দেশের চেয়ে ভালো।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ণে চীন যে ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে, তাতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। চীনের মতো ভারতও বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে পারে।’

আরও পড়ুন: রাজনৈতিক সম্পর্কও চায় চীন

/এমএনএইচ/