নতুন বছরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রভাব ফেলবে না অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায়

অর্থনীতির সূচক ঊর্ধ্বমুখী
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে আগামী বছর অর্থনীতির গতি ভালো থাকবে বলে মনে  করছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। যদিও অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে। ২০১৭ সালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানের তুলনায় কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। তবে এই পরিবর্তন অর্থনৈতিক খাতকে প্রভাবিত করতে পারবে না বলেও মত প্রকাশ করেছেন তারা।  
এদিকে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পরিচিত বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি যে সব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেসব প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করেছে। সব মিলিয়ে আগামী বছরও অর্থনৈতিক খাতের সাফল্য অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৬ সাল অর্থনৈতিক অর্জন ভালো হয়েছে নিশ্চয়ই। এ বছরের অর্থনৈতিক সার্বিক অর্জনই ভালো। এ অর্জনকে অবশ্যই সুসংহত করতে হবে। এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে।’

এই অর্জনগুলো রক্ষায় ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ নতুন পরিকল্পনার পাশাপাশি পুরনো পরিকল্পনার কাজগুলো অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘আগামী বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক অস্থিরতা বা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি না হলে আগামী বছরও (২০১৭) দেশের অর্থনৈতিক অবস্থ ভালো যাবে।’

তবে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের  (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলতি বছরের মতো আগামী বছরও  দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ হবে কিনা, তা নির্ভর করছে এ বছরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতার ওপর। আশা করা যাচ্ছে,  আগামী বছরও এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে বলে মনে হয়। তবে তা অর্থনৈতিক খাতকে প্রভাবিত করতে পারবে না।’ 

এদিকে দেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ও বহুজাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক যৌথভাবে সম্প্রতি প্রকাশ করেছে  ‘সাউথ এশিয়া’স টার্ন: পলিসিজ টু বুস্ট কমপিটিটিভনেস অ্যান্ড ক্রিয়েট দ্য নেক্সট এক্সপোর্ট পাওয়ার হাউস’ শীর্ষক প্রতিবেদন। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ট্রেড অ্যান্ড কমপিটিটিভনেস গ্লোবাল প্র্যাকটিস বিভাগের প্রধান অর্থনীতিবিদ ভিনসেন্ট পলমেড প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। এতে বলা হয়, ২০৩০ সাল নাগাদ দক্ষিণ এশিয়াই  হবে বিশ্বের মোট কর্মক্ষম জনশক্তির এক চতুর্থাংশেরও বেশি মানুষের আবাস স্থল।  এ দিকটি বিবেচনায় নিয়ে এর অনুকূল জনশক্তি, শিক্ষার ক্রম বর্ধমান হার ও নগরগুলোর বর্ধিষ্ণুতার সুযোগ কাজে লাগানো উচিত। ব্যবসার পরিবেশ উন্নতি, গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের সঙ্গে সংযুক্তি, উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আরও বাড়ানো সম্ভব বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়ন শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি কারিগরি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের আওতা ব্যাপক হারে বেড়েছে বাংলাদেশের। যেখানে ২০০০ সালে মাত্র ১ লাখ ১০ হাজার মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সেখানে ২০১০ সালে এ সংখ্যা ৪ লাখ ৪৮ হাজারে এবং ২০১৪ সালে ৬ লাখ ৯০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। একই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে প্রয়োজনের বেশি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে।

এ প্রসঙ্গে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বছেন, ‘আসলেই অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক খাতে বাংলাদেশ ভালো করছে। তাই এ সংক্রান্ত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে তো এর প্রতিফলন হবে। এটিই স্বাভাবিক।

একই মত পোষণ করেছেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে শুধু অর্থনৈতিক খাতই নয়, অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশ ভালো করছে। এরই প্রতিফলন ঘটছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি বা আইএমএফ-এর ব্যতিক্রম নয়।’   

আগামী ২০১৭ সালের অর্থনেতিক খাতের সাফল্যকে নিয়ে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘অর্থনৈতিক খাতের এই সাফল্য ধরে রেখে সামনে এগুনোর ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে। অভ্যন্তরীণ চ্যলেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ বছর বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি ততটা সুখকর নয়। আগামীতে এটি বাড়ানোর নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন-নতুন কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এ বছর কর্মসংস্থানোর উদ্যোগটিও ভালো ছিল না। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে রেমিটেন্স প্রবাহটা এ বছর ভালো ছিলো না। আগামীবছর তা যেন বাড়ে, সে উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য অদক্ষ নয়, দক্ষজনবল রফতানির উদ্যোগ নিতে হবে। পুরোপুরি করা না গেলেও আংশিক দক্ষ জনবল যেন রফতানি করা যায়, তা নিশ্চিত করা জরুরি। মোট কথা, এ জন্য মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। রফতানি বাড়াতে তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এর পাশাপাশি নতুন নতুন পণ্য রফতানির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। এলডিসি থেকে বের হতেও বাংলাদেশকে এগুলো করতে হবে। ব্যক্তিগত আয় বেড়েছে বাংলাদেশের মানুষের, তবে আয় বৈষম্যও বেড়েছে। এই বৈষম্য কমাতে না পারলে সমাজে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে। আগামী বছরের জন্য এটি একটি চিন্তার কারণ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘর ছুঁয়েছে। এটি ধরে রাখতে হবে।’  

এদিকে সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘এ বছরের মতোই আগামী বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ হবে কিনা, তা নির্ভর করছে এ বছরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতার ওপর। সরকারের গৃহীত বড় প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্পে বিশেষ করে পদ্মাসেতু প্রকল্পে অগ্রগতি হবে। অন্য কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন ইস্যুতে সরকার চাপে থাকবে, বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ইপিজেড এবং রেলপথ বিষয়ক প্রকল্পে। যেহেতু সরকার বড় বাজেট বাস্তবায়ন করছে, সেহেতু বড় বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আদায় একটি বড় বিষয়। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে স্বাভাবিকভাবেই সরকার কিছুটা চাপে থাকবে। বেসরকারি বিনিয়োগ পাওয়া যাবে কিনা, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতেও সরকার অনেকটাই চাপে থাকবে। আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন আর্থিক খাতের ব্যাপক সংস্কার। এই সংস্কারের পথের বাধাগুলো সরাতে হবে। ’

এ ছাড়া বৈশ্বিকভাবেও কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘যা নির্ভর করছে নতুন মার্কিন সরকারের বাণিজ্যনীতি ও যুক্তরাজ্যের রেক্সিট পরিস্থিতির ওপর। নতুন মার্কিন সরকারের বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের মনোভাব, বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং সহযোগিতা নীতির পরিবর্তনের ওপরও কিছুটা নির্ভর করবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’ তিনি বলেন, ‘আগামী বছর আরএমজি খাতের সংস্কারে রফতানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। উন্নতি হবে এ খাতের।’ শ্রমিকদের দাবি দাওয়া সংক্রান্ত ইস্যুতে কিছুটা পরিবর্তন হবে বলেও মনে করেন তিনি।  

/এমএনএইচ/