বাংলাদেশের চিনি শিল্পের যত সমস্যা

চিনি-১স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতে না পারলেও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চিনিকলগুলোতে উৎপাদন খরচ আকাশচুম্বি। এসব চিনিকলে প্রতি কিলোগ্রাম চিনি উৎপাদনে খরচ হয় ৩২৪ টাকা। যদিও বর্তমানে বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৬০ টাকা দরে। বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসব ভারি কারখানাগুলো স্থানীয় চিনির চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। যার প্রধান কারণ আখের স্বল্পতা এবং সরকারকে ব্যক্তি খাত থেকে চিনি কিনতে বাধ্য করা।

বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তথ্য মতে, দেশে চিনি খাতে পুঞ্জিভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। একই সময়ে দেশের ১৪ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মিলগুলোতে চিনি উৎপাদিত হয় মাত্র ৭৭ হাজার ৪৫০ টন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বাংলাদেশে বার্ষিক মাথাপিছু চিনির চাহিদা ৯ কেজি।

চিনি-২বর্তমানে বিএসএফআইসি’র অধীনে ১৫টি চিনির মিল রয়েছে। যেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বছরে দুই লাখ ১০ হাজার ৪৪০ টন। এই মিলগুলোর মধ্যে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড বছরে সামান্য মুনাফা করে। যদিও এ মিলে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ১৮৬ টাকা। গত অর্থবছরে কেরুর চিনি ইউনিটে ৪৩ কোটি টাকা লোকসান হলেও ডিস্টিলারি ইউনিট ৫৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।

কাঁচামালের ঘাটতি

বিএসএফআইসি’র চেয়ারম্যান একেএম দেলওয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের অধীনে অধিকাংশ মিলের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু কাঁচামালের (আখ) ঘাটতির কারণে আমরা তা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাজারে আখের ঘাটতি থাকায় কেরু অ্যান্ড কোম্পানি চলতি মৌসুমে মাত্র ৭৬ দিন চালু ছিল।’

চিনি-৫কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরশাদ আলী বলেন, ‘উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় শুধুমাত্র শীত মৌসুমে কোম্পানিটি উৎপাদনে যায়। কারণ এ সময় কৃষকরা আখ চাষ করেন। সুতরাং মিলটি বছরে ছয় মাস চালু রাখা উত্তম হতো, কিন্তু আখের স্বল্পতার কারণে আমরা সেটা করতে পারি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘চিনি উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল প্রয়োজন হয়। যা চিনির উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়। মিলগুলো অলস পড়ে থাকলে চিনির উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়।’

চিনি-৩আখ উৎপাদন কমছে

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য হারে আখের উৎপাদন কমেছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের (ডিএই)  তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মোট দুই লাখ ৮১ হাজার একর জমিতে ৫৫ লাখ টন আখ উৎপাদন হয়। চলতি অর্থবছরে যা কমে প্রায় অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে দেড় লাখ একর জমিতে আখ চাষ হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের (ডিএই) উপ পরিচালক (আখ) মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘বাজারে অন্যান্য অর্থকরী ফসলের চেয়ে আখের দাম কম হওয়ায় কৃষকরা আখ চাষে অনীহা দেখান। কৃষকরা সারাবছর জমিতে আখ রাখতে রাজি নন, কারণ একই সময়ে তারা তিনটি অন্য ফসল তুলতে পারেন।’

চিনি-৪ঝিনাইদহের কৃষক আব্দুল বাতেন দু’বছর আগে আখ চাষ বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রতি একর জমিতে ২০ হাজার টাকা ব্যয় করে ১৯ টন আখ উৎপাদন করতে পারি। যা প্রতিটন তিন হাজার ১২০ টাকা দরে ৫৯ হাজার ২৮০ টাকা বিক্রি করা সম্ভব। কিন্তু একই সময়ে একই পরিমাণ জমিতে আলু, ধান ও সবজি বা আলু, ভুট্টা ও ধান চাষ করে দ্বিগুণ মুনাফা করা সম্ভব।’

রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন ১৫টি চিনি কলের মধ্যে মাত্র ৫টির নিজস্ব আখ চাষের জমি আছে। মিলগুলো হলো- ঠাকুরগাঁও চিনি কল, সেতাবগঞ্জ চিনি কল, মহিমাগঞ্জ চিনি কল, গাইবান্ধা চিনি কল এবং কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। তবে অজানা কারণে এসব মিলের অধিকাংশ জমি অনাবাদী থেকে যায়।

মোবারকগঞ্জ চিনি কলের জেনারেল ম্যানেজার মো. আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘আবাদযোগ্য জমিতে আখ  চাষ না করা অদক্ষতার পরিচয়। যদি এসব মিলগুলো নিজস্ব জমিতে আখ  চাষ করতে পারে, তবে এ খাতের লোকসান কমে আসবে।’

সৌজন্য: ঢাকা ট্রিবিউন

/এসএনএইচ/  এপিএইচ/