চালের দাম ২৩ টাকা বেড়ে কমেছে সাত টাকা

চালএ বছরের (২০১৭) মার্চের শেষ দিকে দেশের হাওর অঞ্চলের অকাল বন্যার অজুহাতে দেশের বাজারে চালের দাম বাড়তে থাকে। ৩২ টাকা কেজি দরে মার্চে বিক্রি হওয়া মোটা চালের দাম সেপ্টেম্বরে ৫৫ টাকায় ওঠে। চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে কিছুটা কমে ৪৮ থেকে ৫২ টাকায় নেমে আসে। অঙ্কের হিসাবে দেখা গেছে, চালের দাম বেড়েছিল কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২৩ টাকা। দাম কমেছে সর্বোচ্চ ৭ টাকা। এই হিসাব অনুযায়ী এখনও প্রতিকেজি চাল কিনতে ক্রেতাকে অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে ১৩ টাকা। অথচ  সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে, চালের দাম কমেছে। সরকারের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ ক্রেতাদের প্রশ্ন—চালের দাম আসলেই কি কমেছে?

গত মার্চের শেষে হাওর এলাকার ৬ জেলায় পাহাড়ি ঢল ও অকাল বন্যায় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতির মধ্য দিয়ে দেশে চালের সংকট শুরু হয়। হাওরের বন্যাকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দেন। সেই থেকে শুরু হওয়া চালের দাম এখনও স্থিতিশীল হয়নি।হাওরের বন্যার পানি কমতে থাকলেও এরই মধ্যে শুরু হয় দেশের ৩২ জেলায় অকাল বন্যা। এই বন্যা চালসংকটকে তীব্রতর করেছে। ফলে ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজি মোটা চালের দাম সেপ্টেম্বরে ৫০ থেকে ৫২ টাকায় ওঠে। সরু চালের কেজি এখন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। চালের  বেশি মূল্য ঠেকাতে এর আগে আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতংশে নামিয়ে আনা হয়। এরপর প্রতিকেজি চালের দাম কমেছিল মাত্র ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা। অথচ দাম বেড়েছিল কেজিতে গড়ে ১০ টাকা।

বর্তমানে চালের সংকট মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগের ফলে বর্ধিত দাম তেমন না কমলেও মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু গত ২৫ আগস্ট থেকে দেশে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আসায় আবার অস্থিশীল হয়ে উঠেছে চালের বাজার। গত ১০ দিনে চালের দাম আবার কেজিতে বেড়েছে ৪ থেকে ৬ টাকা। ফলে মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি আবার ৪৮ থেকে ৫০ টাকা ছুঁয়েছে।

বাজারে চাল দাম কেজিতে বেড়েছিল কমপক্ষে ১৩ টাকা। বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হলে দেশের বাজারে চালের সরবরাহ ঠিক রাখাসহ সংকট মেটাতে শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই মধ্যে আমদানি চালের প্রথম দু’টি চালান বন্দরে এসে পৌঁছায়। এতে ওই সময় পাইকারি বাজারে চালের দাম কেজিতে কমেছিল মাত্র ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চালের মোকাম-খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজারে আবারও বেড়েছে নতুন চালের দাম। এ বছর আমন ধানের ভালো উৎপাদন হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ দাবি করলেও কৃষকরা বলছেন অন্যকথা।তারা বলছেন, ফলন খারাপ হওয়াসহ গ্রামের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ধান গুদামজাত করে রাখায় চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, গত একবছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ। আর মাসিক মূল্যের ভিত্তিতে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বছর ভিত্তিতে টিসিবি দেখিয়েছে, একবছর আগে এ চালের প্রতিকেজির দাম ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। আর বাজারে বর্তমানে এ চালের দাম কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে। প্রতিকেজি মোটা চালের দাম বেড়েছে ১৬ টাকা।

এদিকে, বাজার বিশ্লেষণকারী বেসরকারি সংস্থা কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক বিশ্লেষণে বলেছে, গত একদশকে পাঁচ ধরনের চালের বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব ধরনের চালের দাম ১০ বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।

খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের মার্চ-আগস্ট পর্যন্ত এই ৬ মাসে মোটা চালের গড় দর ছিল ৩৮ টাকা ২২ পয়সা।  কিন্তু হঠাৎ এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে (১৭ তারিখ) প্রতিকেজি মোটা চালের দাম ছিল ৪১ টাকা ৫০ পয়সা। একমাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা। মার্চ মাসে প্রতিকেজি মোটা চালের দাম ছিল ৩৩ টাকা ২১ পয়সা। এপ্রিলে মোটা চালের দর ছিল ৩৩ টাকা ৩৯ পয়সা। মে মাসে ৩৬ টাকা ৩৯ পয়সা। জুন মাসে ৩৮ টাকা ৩২ পয়সা। জুলাই মাসে ৩৮ টাকা ৭৭ পয়সা।  আগস্টে ৩৮ টাকা ২২ পয়সা।          

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ‘বাবুবাজার-বাদামতলী চালের আড়ৎদার সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক আলহাজ নিজাম উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চালের মূল্য যে হারে বাড়ে, সে হারে কমে না। চালের মূল্য কমাতে আমদানি শুল্ক কমানো হলেও বেশি দামে কিনে এনে ব্যবসায়ীরা সুবিধা করতে পারেননি। তাই প্রত্যাশা অনুযায়ী দাম কমেনি।’

জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চালের দাম এখন অনেক কমেছে। চালের দাম সহনীয় রাখতে সরকার আমদানি শুল্ক ৪৮ শতংশ থেকে কমিয়ে মাত্র ২ শতাংশ করেছে। দাম আর বাড়বে না।’  দাম আরও কমবে বলেও জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।

তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত রবিবার এক অনুষ্ঠানে চালের মূল্যবৃদ্ধিকে অসহনীয় বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘কৃষকদের সুবিধার জন্য সরকারই চালের দাম কিছুটা বাড়াতে চেয়েছে। কিন্তু চালের দাম যে পরিমাণ বেড়েছে, তা অসহনীয়। সম্প্রতি বেড়ে যাওয়ার পরিমাণটা অস্বাভাবিক। মোটা চালের কেজি ৫০ টাকার ওপরে উঠে যাওয়ায় কিছু লোকের খুব অসুবিধা হয়েছে। দামটা আসলে অনেক বেড়েছে।’ আগামীতে উৎপাদন বাড়লে চালের দাম কমে আসবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।