ব্যাংক দেউলিয়া হলে আমানতকারীদের টাকা যেভাবে ফেরত দেওয়া হয়



ব্যাংকে লুটপাটকোনও ব্যাংককে দেউলিয়া ঘোষণা করা হলে কপাল পোড়ে আমানতকারীদের। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর কোনও কোনও আমানতকারী কিছু টাকা ফেরত পেলেও বেশিরভাগ গ্রাহককেই খালি হাতেই ফিরতে হতে পারে। এ জন্য ব্যাংকে আমানত রাখার বিষয়ে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। টাকা রাখার আগেই ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে ব্যাংক বাছাই করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।  তবে ব্যাংক যদি পরে দেউলিয়া হয়েই যায় তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে কিছু টাকা ফেরত পেতে পারেন আমানতকারীরা।

জানা গেছে, ভারত বিভক্তির পর দেউলিয়া হওয়া পাইওনিয়ার ব্যাংক এবং ক্যালকাটা মর্ডান ব্যাংকের লিকুইডেশনের সমস্যা এখনও সমাধান হয়নি। তবে সর্বশেষ ২০০৬ সালে দেউলিয়া হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। মালিকপক্ষের লুটপাটের কারণে অতিরুগ্ন হয়ে পড়লে ওই বছরের ১৯ জুন ব্যাংকটির দায়িত্ব নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে মালিকপক্ষের ৮৬ শতাংশ শেয়ারের বড় অংশ কিনে নেয় আইসিবি গ্রুপ। তারপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে করা হয় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। কিন্তু গ্রাহকরা এখনও টাকা ফেরত পাননি। ১৯৯২ সালে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বিসিসিআই) বিলুপ্ত হয়ে ইস্টার্ন ব্যাংক গড়ে উঠেছিল। যদিও বিসিসিআই’র বিভিন্ন দেশের গ্রাহকরা এখনও টাকা ফেরত পাননি।

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যখন কোনও ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়, তখন লিক্যুইডেটর নিয়োগ দিতে হয়। লিক্যুইডেটরের কাজ ব্যাংকের সম্পদ কেমন আছে তার খোঁজ নিয়ে আমানতকারীদের পাওনার একটি তালিকা করা। সেই তালিকা অনুযায়ী প্রথমে ছোট আমানতকারী ও পরে বড় আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হয়। কে কোন মাসে কী পরিমাণ আমানত পাবেন সেটাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।’

এদিকে দেউলিয়া ঘোষণা না হলেও নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক এবং এনআরবিসি ব্যাংক কঠিন সমস্যায় পড়েছে। এ দুটির ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং এমডিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য আর্থিক সংকটের কারণে বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকের আমানতকারীরা গত কয়েক মাস ধরে তাদের টাকা তুলতে পারছেন না। এমন অবস্থায় শেয়ার ছেড়ে ব্যাংকটিকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে।

এ প্রসঙ্গে ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে অচিরেই এক হাজার একশ কোটি টাকার ফান্ড পাওয়া যাবে এবং পাঁচশ কোটি টাকার বন্ড ছাড়া হচ্ছে। ফলে এক হাজার পাঁচশ কোটি টাকা আসলে কিছু গ্রাহকের চাহিদা মেটানো যাবে।’

যদিও দেউলিয়া বিষয়ে কোনও পৃথক আইন নেই। তবে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৭৪ ধারায় বলা আছে, আদালত কোনও ব্যাংকের অবসায়নের আদেশ দিলে তিন মাসের মধ্যে সরকারি অবসায়ক আমানতকারী ও আমানতের তালিকা বীমা ট্রাস্টি বোর্ডের কাছে দাখিল করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ব্যাংক আমানত বীমা নামে একটি তহবিল আছে। কোনও ব্যাংক দেউলিয়া হলে আমানতকারীদের ওই তহবিল থেকে কিছু টাকা দেওয়ার সুযোগ আছে। তবে দেউলিয়া ঘোষিত ব্যাংকে প্রশাসক বা অবসায়ক নিয়োগ পাওয়ার পরও বড় গ্রাহকদের আমানত ফেরত পেতে অপেক্ষা করতে হয় ব্যাংকের সম্পদের ওপর ভিত্তি করে। এ জন্য এখন সময় এসেছে ব্যাংক আমানত বীমা তহবিল সংস্কার করার। এই তহবিলও বাড়ানো দরকার। কারণ এখন অনেকগুলো ব্যাংক দেউলিয়া পর্যায়ে রয়েছে।’

মাসের পর মাস গ্রাহক তার আমানত ফেরত না পেলেও বাংলাদেশে কোনও ব্যাংককে দেউলিয়া ঘোষণা করা হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ব্যাংক যত খারাপই হোক না কেন দেউলিয়া ঘোষণা করলে ব্যাংকের মালিকরা সব ধরণের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। সমাজেও তাদেরকে খারাপ বলা হবে। আবার কোনও ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষণা হলে এর প্রভাব অন্য ব্যাংকেও পড়বে। কারণ গ্রাহক অন্য ব্যাংক থেকেও টাকা উঠানো শুরু করে দেবে।’

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেকোনও ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষণা হলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে ওই ব্যাংকের আমানতকারীরা। কারণ, তাদের টাকা আটকে যাবে। এ জন্য ভিত্তি দুর্বল বা দেউলিয়া পর্যায়ের কোনও ব্যাংকে আমানত না রেখে সর্তক হয়ে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে ভালো ব্যাংকে আমানত রাখা উচিত। কোনও ব্যাংকই ঘোষণা দিয়ে দেউলিয়া হয় না। যখন আমানতকারীরা টাকা ফেরত পায় না, তখনই বুঝে নিতে হয় ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। ব্যাংকটি আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এই আমানত ফেরত পেতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হবে। শুধু ফারমার্স ব্যাংকই নয়, আরও কয়েকটি ব্যাংক ইতোমধ্যে দেউলিয়া পর্যায়ে চলে গেছে। এ জন্য মূলত সুশাসন না থাকা এবং সরকারের অবহেলা দায়ী। কারণ ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সর্তক থাকার দরকার ছিল।’

আমানতকারীদের টাকা ফেরতের বিষয়ে হাসান মনসুর বলেন, ‘কোনও ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষণা হলে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেবে। যিনি আমানতকারীদের তালিকা করে ধীরে ধীরে টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। এক্ষেত্রে বড় আমানতকারীদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করা লাগতে পারে।’

জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংক আমানত বীমা তহবিলে র্ব্তমানে পাঁচ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা জমা আছে। প্রতি ছয় মাস পর ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের ওপর নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম জমা দিতে হয়। কোনও ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে প্রিমিয়াম পরিশোধে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকে তার রক্ষিত হিসাব থেকে প্রিমিয়ামের সমপরিমাণ অর্থ কেটে নেয়। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো হলে কম প্রিমিয়াম এবং খারাপ হলে বেশি হারে প্রিমিয়াম দিতে হয়।  স্বাভাবিক ব্যাংকগুলোকে প্রতি ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮ পয়সা হারে প্রিমিয়াম জমা দিতে হচ্ছে। এছাড়া সতর্কতামূলক অবস্থায় (আরলি ওয়ার্নিংয়ে) থাকা ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৯ পয়সা হারে এবং সমস্যাগ্রস্ত (প্রবলেম) ব্যাংক ১০ পয়সা হারে প্রিমিয়াম জমার বিধান করা হয়েছে। এর আগে প্রতি ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ৭ পয়সা হারে প্রিমিয়াম জমা দিতে হতো।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোনও ব্যাংকের অবসায়ন ঘটলে ব্যাংকের গ্রাহকদের এই বীমার আওতায় ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। সংশোধীত ব্যাংক কোম্পানি আইন কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত অবসায়িত ব্যাংকে আমানতকারীর সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হতো। কোনও আমানতকারীর এক লাখ টাকা জমা থাকলে তিনি পুরো অর্থই ফেরত পেতেন। তবে বেশি থাকলেও সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা দেওয়া হতো।’

আরও পড়ুন:
বর্তমান সরকার ফের ক্ষমতায় আসলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা থাকবে: বাণিজ্যমন্ত্রী