ভালো নেই যেসব ব্যাংক

 

বাংলাদেশ ব্যাংকছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে গ্রাহকদেরকে টাকা ফেরত দিতে পারছে না ফারমার্স ব্যাংক। শুধু তারাই নয়, এমন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে আরও ডজনখানেক ব্যাংক। এর মধ্যে ৯টি ব্যাংক ইতোমধ্যে তার মূলধন ভেঙে খাওয়া শুরু করেছে। এছাড়া নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে আরও একডজন বাণিজ্যিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মার্চ প্রান্তিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে এই ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ এখন ১০ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আরও ভয়ঙ্কর তথ্য। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি কোনও ব্যাংকের শীর্ষ ১০ গ্রাহক খেলাপি হয়ে যান, তাহলে ৩৮ ব্যাংক নতুনভাবে মূলধন ঘাটতিতে পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৭ সালের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনও ব্যাংকের সাতজন করে গ্রাহক ঋণখেলাপিতে পরিণত হলে ৩৪ ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি দেখা দেবে। আর তিনজন করে গ্রাহক খেলাপি হলে ১৯টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়বে। ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি বিবেচনা করে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বর্তমানে একটি ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ বা ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে যেটি বেশি সেই হারে মূলধন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়ে মূলধন খেয়ে ফেলছে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ৯টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। এর মূলধন ঘাটতি এখন ৭ হাজার ৭৭৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। মূলধন ঘাটতির দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। তাদের মূলধন ঘাটতি ৫ হাজার ৩৯৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ৬৫৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ঘাটতি ৮১৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি ৬৩৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা ও জনতা ব্যাংকের ১৬১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে।

এছাড়া বেসরকারি খাতের আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৪৯৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, ফারমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ২৮২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ২৪৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম আর দুর্নীতি প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রভাবশালীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে প্রভিশন ঘাটতিও বাড়ছে। আর প্রভিশন ঘাটতি মেটাতে গিয়ে মূলধন ভেঙে ফেলছে।’

এই সাবেক গভর্নর উল্লেখ করেন, প্রতি বছরই জনগণের করের টাকায় বাজেট থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোকে মূলধন জোগান দেওয়া হয়। তার মতে, মূলধন সরবরাহের সরকারি উদ্যোগের কোনও যুক্তিযুক্ত নেই। এই উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা ও দুর্নীতিকে উৎসাহিত করার শামিল।

একই অভিমত ব্যক্ত করলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই খাতে সুশাসন না থাকার কারণে ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। প্রভাবশালীদের চাপে সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে বেশকিছু অসাধু লোক ঋণ নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছে না। এখন এই রোগ বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও দেখা দিয়েছে। যে কারণে খেলাপির পরিমাণ বাড়ছে। আর খেলাপি বৃদ্ধির কারণে প্রভিশন ঘাটতি হচ্ছে। মূলধনেও ঘাটতি বাড়ছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোও ঝুঁকির মুখে পড়ছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ঋণমান অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হয়। কিন্তু খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে পারছে না দেশের ১২টি ব্যাংক।

সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ শেষে ১২টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। এই সময়ে প্রভিশন ঘাটতির শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। এর ঘাটতি এখন ৩ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। এছাড়া বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা ও রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।

অন্যদিকে নতুনভাবে প্রভিশন ঘাটতিতে যুক্ত হয়েছে এবি ব্যাংক। এর ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৫৫ কোটি টাকায়। এছাড়া আইএফআইসি ব্যাংকের ঘাটতি ২৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ঘাটতি ১১৪ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি ১৪০ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ঘাটতি ১২০ কোটি টাকা ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৮ কোটি টাকায়।

আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে ঋণের শ্রেণিমান বিবেচনায় প্রতিক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন রাখতে হয় নির্ধারিত হারে। সাধারণ ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখার নিয়ম রয়েছে। আর যথাসময়ে আদায় না হওয়া নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ বা ক্ষতি অর্থাৎ শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে যথাক্রমে ২০, ৫০ ও ১০০ ভাগ হারে প্রভিশন রাখতে হয়।