যে কারণে বাড়ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি

টাকাচলতি অর্থবছর শেষে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। সম্প্রতি এমনটিই জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের বেশি হওয়ার আভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি। তবে বিশ্বব্যাংক বলেছে, এ বছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। জিডিপির এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ, রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। তবে জিডিপি অর্জনের অগ্রগতি ধরে রাখতে ব্যাংক আইনের কঠোর প্রয়োগ, করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সরকারি ব্যাংগুলোকে একীভূতকরণসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরেন তারা।

গত ১৯ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভা শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, ‘অর্থনীতির প্রত্যেকটি খাতে আমাদের প্রবৃদ্ধি ভালো। মূল খাতে উৎপাদন বাড়ায় রফতানি ও বিনিয়োগ বেড়েছে। সে জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধি ভালো।’

এ সময় অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন খাতে জিডিপি বাড়া-কামার বিষয়ে একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। তিনি জানান, ‘কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ১১ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত অর্থবছর শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৭ দশমিক ১৩ শতাংশ; এ অর্থবছরে তা ১৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। উৎপাদনশীল খাতে গত অর্থবছরে জিডিপি ছিল ১৮ দশমিক ২৩ শতাংশ; এ অর্থবছরে ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। সেবা খাতে ছিল ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ; এ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে দ্রুতগামী, যা গর্ব করার মতো। কিন্তু টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নজর দিতে হবে। প্রবাসী আয়ের প্রভাবে ব্যক্তি খাতে চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি অবকাঠামো খাতে সরকারের বাড়তি বিনিয়োগের কারণেই মূলত প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ধরে রাখতে আগামীতে শিল্পের ভিত্তি বাড়াতে হবে। গড় আয় বাড়লেও প্রকৃত আয় বাড়ছে না। এ ক্ষেত্রে আয় বৈষম্য কমাতে হবে।

তারা মনে করেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে, রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। ব্যক্তি খাতের উন্নতি নিশ্চিতে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে হবে। সরকারের ব্যয় নির্বাহ করতে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তি খাতের চাহিদা মেটাতে মানবসম্পদের উন্নয়ন করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের সংস্কারেও গুরুত্ব দিতে হবে। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির এ ধারা ধরে রাখা সম্ভব হবে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা-সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জিডিপি উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা ইতিবাচক। ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে ৭ শতাংশের বেশি অর্জন আসলেই বিস্ময়কর। যা সবাই স্বীকার করছেন। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। তবে বড় উদ্যোক্তা ও ছোট উদ্যোক্তার মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য কমাতে হবে। প্রবৃদ্ধির এই ধারায় গুণগত মান অর্জনের দিকে নজর দিতে হবে।’

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমাদের গড় আয় বাড়লেও বাড়েনি প্রকৃত আয়। ফলে আয় বৈষম্য বাড়ছে। যা উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। এটি নিঃসন্দেহে গুণগত দুর্বলতা। এ দুর্বলতা কাটিয়ে সমৃদ্ধ প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে মনোযোগী হতে হবে।’

সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রবৃদ্ধি অর্জনের এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে চ্যালেঞ্জ অনেক। এ ক্ষেত্রে সুশাসন ও জবাববিদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। যা আসলেই চ্যলেঞ্জিং। এই ধারা অব্যাহত রাখতে অর্থনীতির সূচকগুলোকে ঠিক মতো তদারকি করতে হবে। তা না হলে এ ধারার ব্যত্যয় ঘটতে পারে।’

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ন্যূনতম ৭ শতাংশ থাকবে বলে আমরা মনে করছি। তবে এর জন্য চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম ব্যাংকিং খাত এবং রাজস্ব খাত। এ দুই খাতে সংস্কার আনতে হবে। ঋণ পুনঃতফসিল করণ প্রক্রিয়া ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়াচ্ছে। খেলাপি ঋণ একটি ছোঁয়াছে রোগ। বিপদগ্রস্ত বলেই একই গ্রহীতা বারবার ঋণ পুনঃতফসিল করছেন, যা খুবই দুঃখজনক।’

২০১৭-১৮ অর্থবছর ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যে প্রাক্কলন করেছে, তাতে ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ।

বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধির বিষয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, এশিয়ার দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশটিতে ব্যক্তি চাহিদা বেড়ে যাওয়া, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে অবকাঠামো খাত বেড়ে যাওয়ায় এ অর্জন সম্ভব হয়েছে।

এডিবি বলেছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার বেশি। বিনিয়োগের তুলনায় মুনাফার হার কম। এখানে সুশাসন ব্যবস্থাও দুর্বল। এর ফলে বাড়ছে মূলধন ঘাটতির প্রবণতা। ব্যাংকিং খাত পরিচালনায় ও আইনি কাঠামোয় বড় ধরনের অদক্ষতা রয়েছে। ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতায় নেওয়া আগের অনেক উদ্যোগ সফল হয়নি। যদিও ব্যাংক আইন সংশোধন, ব্যাংকে বিশেষ নিরীক্ষা ও ঋণের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গাইডলাইনে কিছুটা সফলতা এসেছে। উন্নতি ধরে রাখতে আগামীতে বিদ্যমান ব্যাংক আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ঋণের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা যাচাই করা, সরকারি ব্যাংকে একীভূতকরণের মতো উদ্যোগ বাস্তবায়নের সুপারিশ, জাতীয় পর্যায়ে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলারও পরামর্শ দিয়েছে এডিবি।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক বলেছে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হলেও রফতানি ও রেমিট্যান্সে ভর করেই বাংলাদেশ এ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে ইথিওপিয়ার ৮ দশমিক ৮ শতাংশ, রুয়ান্ডার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, ভুটানের ৭ দশমিক ৬ শতাংশ ও ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সেই অনুপাতে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেশি।