বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলা: বরখাস্ত হচ্ছেন অভিযুক্ত কর্মকর্তারা

বড়পুকুরিয়াশেষ রক্ষা হচ্ছে না দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া খনি দুর্নীতি মামলার আসামিদের। এই মামলার আসামির তালিকাভুক্ত ২৩ কর্মকর্তার মধ্যে তিন জনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে পেট্রোবাংলা। বাকিদেরও শিগগিরই সাময়িক বরখাস্ত করা হবে। আর এই বরখাস্তের আদেশ কার্যকর হবে ১৫ অক্টোবর আদালতের চার্জশিট গ্রহণের তারিখ থেকেই। মামলা চলার সময়ে তারা আর চাকরিতে যোগ দিতে পারবেন না। পেট্রোবাংলা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বড়পুকুরিয়া মামলা হওয়ার পর থেকেই আসামি পক্ষ দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। মামলার চার্জশিট আদালতে জামা দেওয়ার পর সেই দৌড়ঝাঁপ আরও বেড়ে যায়। আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় চুরি যাওয়া কয়লাকে ‘সিস্টেম লস’ হিসেবে দেখানোরও চেষ্টা চালান। কিন্তু বড়পুকুরিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ কয়লা চুরির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এদিকে, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে এক লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা (যার আনুমানিক মূল্য ২৪৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা) আত্মসাতের অভিযোগে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক সাত ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) ২৩ জনের বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) চার্জশিট গ্রহণ করেছেন আদালত। একইসঙ্গে বিচারক তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিরও আদেশ দিয়েছেন। এরপর বুধবার (১৬ অক্টোবর) বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমেদসহ তিন জনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া, আদালত বাকি ২০ জনের জামিন মঞ্জুর করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রশাসন) গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘তিন জনকে আগেই সাময়িক বরাখাস্ত করা হয়েছে। বাকিদের বিষয়ে আমরা চার্জশিটের সার্টিফাইড কপি হাতে পেলে সিদ্ধান্ত নেবো। এজন্য বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রস্তাব পাঠাতে।’ তিনি বলেন, ‘কর্মরতদের বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। এরমধ্যে আবার যারা বড়পুকুরিয়ায় কর্মরত, তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বড়পুকুরিয়া বোর্ড চাকরিবিধি অনুযায়ী।’

পেট্রোবাংলার এই পরিচালক আরও বলেন, ‘চাকরিবিধি অনুযায়ী গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরই তাদের বরখাস্ত করা হয়। আগামী রবিবার বা সোমবারের মধ্যেই আমরা তাদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবো। সেক্ষেত্রে কেউ যদি আপিল করে স্থগিতাদেশ না আনেন, তাহলে তারা চাকরিচ্যুত হবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘বড়পুকুরিয়ার সাবেক এমডিদের মধ্যে যারা অবসরপ্রাপ্ত, তাদের বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে কেউ যদি অন্য কোনও কোম্পানিতে কর্মরত থাকেন, সেই প্রতিষ্ঠান তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়াদের মধ্যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সদস্য হিসেবে আছেন বড়পুকুরিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আজিজ এবং রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুজ্জামান।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আরপিজিসিএল-এর কামরুজ্জামানের চাকরি চুক্তিভিত্তিক। তার চাকরির মেয়াদ আছে আগামী মাস (নভেম্বর) পর্যন্ত। এখন গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর চাকরি বিধি অনুযায়ী বরখাস্ত করার নিয়ম থাকলেও শেষ সিদ্ধান্ত নেবে কোম্পানির বোর্ড। অন্যদিকে, বিইআরসির সদস্য আব্দুল আজিজ একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি এখন বিইআরসিতে সদস্য হিসেবে কর্মরত আছেন, যার নিয়োগ দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতির আদেশে।

সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমেদ ছাড়া জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশভুক্ত অন্য দুই জন হলেন, ঘটনা ধরা পড়ার সময়কার মাইন অপারেশন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আবু তাহের মো. নূরুজ্জামান চৌধুরী ও স্টোর বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক একেএম খালেদুল ইসলাম।

এর বাইরে অভিযুক্তদের মধ্যে প্রকৌশলী এস এম নুরুল আওরঙ্গজেবকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানের দফতরে সংযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া, মো. মাহবুবুর রহমান, প্রকৌশলী খুরশীদুল হাসান, মো. আমিনুজ্জামান রয়েছেন অবসরে। এছাড়া চার্জশিটে নাম আসা সাবেক মহাব্যবস্থাপক মো. শরিফুল আলম অবসরে রয়েছেন।

আসামিদের মধ্যে দুজন অন্য কোম্পানিতে বদলি হয়ে গেছেন।এরমধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন আবুল কাশেম প্রধানীয়া। খনি দুর্নীতির অভিযুক্ত হিসেবে তার নাম আসে। ওই সময় যাদেরই নাম আসে, তাদের বেশিরভাগকেই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু বড়পুকুরিয়ায় কোম্পানি সচিবের দায়িত্বে থাকা কাসেম প্রধানীয়াকে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানিতে বদলি করা হয়। এছাড়া, ব্যবস্থাপক মাসুদুর রহমান হাওলাদার সুন্দরবন গ্যাস বিতরণ কোম্পানিতে বদলি হয়ে গেছেন।

এছাড়া, উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জোবায়ের আলী, ব্যবস্থাপক মো আরিফুর রহমান, সৈয়দ ইমান হাসান, উপ-ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ খলিলুর রহমান, মো. মোর্শেদুজ্জামান, মো. হাবিবুর রহমান, মো. জাহেদুর রহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বর্মণ, মো. শোয়েবুর রহমান, অশোক কুমার হালদার, সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মনিরুজ্জামান বড়পুকুরিয়ায় কর্মরত রয়েছেন।

উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই পর্যন্ত এক লাখ ৪৩ হাজার ৭২৭ দশমিক ৯২ টন কয়লা চুরি হয় বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে, যার আনুমানিক মূল্য ২৪৩ কোটি ২৮ লাখ ৮২ হাজার ৫০১ টাকা ৮৪ পয়সা। এই ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে এবং কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়।

পেট্রোবাংলার বাইরে চাকরি করা অন্যদের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে সে সম্পর্কে জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকারি চাকরির একটি নিয়ম বা বিধি রয়েছে। চাইলেই তা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, চাকরি বিধি অনুযায়ী যা করা প্রয়োজন, তা-ই করা হবে। এক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তি বিশেষের আলাদা কোনও ব্যবস্থা করার সুযোগ নেই। তাহলে চাকরিবিধি পরিবর্তন করতে হবে। দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্তদের বাঁচানোর জন্য নিশ্চয়ই সরকার তেমন কিছু করবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

আরও পড়ুন:  বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি: আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করলেই জ্বালানিতে বড় পরিবর্তন

কয়লাচুরি: বিইআরসির সদস্য আব্দুল আজিজকে বরখাস্ত করতে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি