নতুন বই প্রকাশ নিয়ে সংশয়

2গত বছরের তুলনায় এবার কাগজের দাম কমেছে অন্তত ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। কাগজের দাম কমার কারণে প্রকাশকদের খরচও কমে আসবে। এতে করে নতুন নতুন বই প্রকাশ করার ব্যাপারে তাদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু না,প্রকাশকদের সেই আগ্রহ একেবারেই নেই। নেই কোনও উচ্ছ্বাসও। কারণ, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব নিয়ে তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। অপরদিকে কাগজের দাম কমে যাওয়ায় অনিশ্চয়তায় মধ্যে পড়েছেন এই শিল্পের উৎপাদক থেকে শুরু করে আমদানিকারক, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা।
প্রকাশক ও কাগজের ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম কমার পাশাপাশি কমেছে প্রকাশনা শিল্পে কাগজের চাহিদাও। মহামারিকালে বই প্রকাশ করছে না অনেকেই। যদিও প্রতি বছর বই মেলাকে সামনে রেখে বেড়ে যায় অফসেট ও আর্ট পেপারের দাম। একইভাবে বই মেলাকে সামনে রেখে বেড়ে যায় বই প্রকাশের সংখ্যাও।
এ প্রসঙ্গে মহাকাল প্রকাশনীর মো. মনিরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘গত বছরের এই সময় থেকেই বই প্রকাশের ব্যাপারে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। বিগত বছরগুলোতে এই সময়ে বড় বড় দামি লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যেত, নতুন লেখকরাও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। কিন্তু এবার চুপচাপ বসে থাকতে হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না, করোনা পরিস্থিতির কারণে মেলা হবে কিনা?’ তিনি বলেন, ‘বই প্রকাশ করার জন্য গত বছরের এই সময়ে যে কাগজের দাম ছিল প্রতি রিম ২১৫০ টাকা। এখন সেই কাগজ সাড়ে ১৪শ’ থেকে ১৫শ’ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। তারপরও প্রকাশকরা অর্থলগ্নি করতে চাচ্ছেন না। আর মেলা না হলে সারাবছর আর্থিক সংকটে থাকতে হবে প্রকাশকদের। কারণ, প্রতি বছর প্রকাশকরা বই মেলা উপলক্ষে তাদের হাতে থাকা সব টাকার পাশাপাশি ঋণ করে বই প্রকাশ করেন। এই মেলা থেকে আয় দিয়েই সারা বছরের ব্যয় নির্বাহ করেন প্রকাশকরা। কিন্তু এবার করোনার অনিশ্চয়তায় কেউ নতুন করে অর্থলগ্নি করতে চাচ্ছেন না।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘একুশে গ্রন্থমেলা-২০২১’ এ হবে না, এটা মেনে নেওয়াটা কষ্টকর। ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে হলেও মেলা হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে করোনা সংক্রমণের হার দ্রুত বেড়ে চলায় দ্বিতীয় ধাপে লকডাউন, কারফিউ ও অন্যান্য কড়া পদক্ষেপের পথে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে ইউরোপের একাধিক দেশ। বাংলাদেশেও কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। আর তেমনটি হলে আগামী অমর একুশে গ্রন্থমেলা যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে পুথিঘর প্রকাশনীর শ্যামল পাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে এবার চাহিদা কম থাকায় কাগজের দাম অন্তত ১০ শতাংশ কমেছে।’ এই ১০ শতাংশ কমে যাওয়াকে স্বাভাবিক দাম বলে অভিহিত করে তিনি বলেন, ‘প্রকাশক ও ছাপাখানা মালিকদের অভিযোগ থাকে, প্রতিবছরই বইমেলার আগে একটি সিন্ডিকেট কাগজের দাম বাড়িয়ে দেয়। এতে বেড়ে যায় বই প্রকাশের খরচ। কিন্তু এবার সে ধরনের কোনও ঘটনা ঘটছে না।’ তবে মেলার প্রস্তুতি শুরু হলে হয়তো কাগজের দাম আবারও বেড়ে আগের মতোই হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, সংক্ষিপ্ত হলেও মেলা হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই মেলা হবে। বাংলা অ্যাকাডেমিও সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘সৃজনশীল প্রকাশনীর সঙ্গে যারা জড়িত, তারা ভালো নেই। আবার সরকারের কাছ থেকে কোনও রকম সহযোগিতাও পাচ্ছি না। ফলে মেলা যদি না হয়, তাহলে প্রকাশকদের বছরজুড়েই বিপদে থাকতে হবে।’
অবশ্য করোনা পরিস্থিতি এখনকার মতো থাকলে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২১ যথাসময়েই, অর্থাৎ আগামী ১ ফেব্রুয়ারি মেলার উদ্বোধন হবে বলে জানিয়েছেন বাংলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনেই এবারের মেলা হবে। তবে নভেম্বর-ডিসেম্বরে করোনা পরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হয়, তখন পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
বাংলা অ্যাকাডেমির তথ্য মতে, গত বই মেলায় ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। নতুন বই প্রকাশিত হয়েছিল ৪ হাজার ৯১৯টি। এ বছর মেলার সংক্ষিপ্ত আয়োজন হলে বই বিক্রি অর্ধেকে নেমে আসতে পারে বলে মনে করছেন প্রকাশকরা।
প্রসঙ্গত, বইমেলাকে সামনে রেখে প্রতি বছর নভেম্বর- ডিসেম্বরে শুরু হয় ছাপাখানাগুলোর ব্যস্ততা। পাঠ্যপুস্তকসহ বই প্রকাশের এই ভরা মৌসুমে কোটি কোটি টাকার কাগজের ব্যবসা হয়।
এদিকে করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং প্রযুক্তি নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার কারণে কাগজ শিল্প অন্তত ৫০ ভাগ ব্যবসা হারিয়েছে বলে জানিয়েছেন কাগজ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, কাগজের উৎপাদন নেমে এসেছে অর্ধেকে। দামও কমেছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের মতো। এতে বিপাকে পড়েছেন ছোট, মাঝারি কিংবা বড় সব শ্রেণির কাগজ ব্যবসায়ী। নয়াবাজারের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিক্রির অবস্থা এমন যে অনেককেই বিকল্প ব্যবসারও চিন্তা করতে হচ্ছে। তারা বলছেন, গত বছরে যেখানে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা বেচাবিক্রি ছিল, সেখানে এখন ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বইমেলার মৌসুমে প্রায় দুই লাখ রিম কাগজের প্রয়োজন হয়। বর্তমানে প্রতি টন অফসেট পেপার বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকায়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কাগজ আমদানিকারক সমিতির সভাপতি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার কারণে স্কুল কলেজ সব বন্ধ। ফলে বাজারে কাগজের চাহিদা কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। বিদেশ থেকে আনা কাগজের দাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমেছে। আর দেশে উৎপাদিত কাগজের দাম কমেছে ৪০ শতাংশ কমেছে।’ তিনি বলেন, ‘বাজারের এই পরিস্থিতির কারণে এই খাতের শ্রমিকদের বেতন দেওয়া কষ্টকর হয়ে গেছে। ’
সব ধরনের কাগজের দামই কমেছে বলে জানিয়েছেন মানিকগঞ্জ পেপার মার্চেন্টস সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও হক অ্যান্ড ব্রার্দাসের মালিক শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গত বছর এই সিজনে কাগজের দাম ছিল ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা প্রতি টন। এবার দাম কমে ৬০ হাজার টাকায় নেমেছে। দাম কমে যাওয়ার কারণে কাগজ শিল্পের সবাই ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব বলছে, করোনাকালে কাগজ বিক্রি কমেছে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত। আর কাগজের দাম কমেছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ।
জানা গেছে, বিক্রি ও দাম কমার কারণে খুচরা বাজারের মতো পাইকার ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বৃহত্তম পাইকারি কাগজের বাজার নয়াবাজারেও ব্যবসায়ীদের এখন গ্রাহক পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
নয়া বাজারের কাগজঘরের মালিক কামাল হোসেন জানান, সাধারণ সময়ে দিনে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকার কাগজ বিক্রি করতেন। বর্তমানে যা দুই থেকে তিন হাজার টাকায় নেমেছে।
বাংলাদেশ পেপার মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের আগে প্রতিদিন দেড়- হাজার টন কাগজ বিক্রি করতে পারতেন পাইকাররা, তবে এখন তারা ১০০ টনেরও কম বিক্রি করতে পারছেন।