ভোগান্তি ও অভিযোগের শেষ নেই টিসিবির পণ্য ক্রেতাদের

মধ্যরাত থেকে অপেক্ষায় থাকার পরও পণ্য না পাওয়া, এক ওয়ার্ডের বাসিন্দা অন্য ওয়ার্ডে তালিকাভুক্ত হওয়া, ডিলারদের স্বজনপ্রীতি ও অসদাচরণসহ নানান রকমের অভিযোগের কথা জানিয়েছেন টিসিবির পণ্য কিনতে আসা ক্রেতারা। তারা বলেন, 'পণ্য বিতরণে কোনও শৃঙ্খলা নেই। নিতেও ভোগান্তি পোহাতে হয়।’

বুধবার (৫ এপ্রিল) রাজধানীর মিরপুরের কয়েকটি টিসিবি পণ্যের বিক্রয় কেন্দ্র ঘুরে এসব অভিযোগের কথা জানা যায়।

দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও পণ্য না পাওয়ার অভিযোগ

মিরপুর ১১ এর বাউনিয়াবাঁধ এলাকায় রাত তিনটার দিকে টিসিবির পণ্য নিতে বিক্রয় কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন বৃদ্ধ মো. আতিক। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা গার্মেন্টস ও রিক্সা চালনার সঙ্গে যুক্ত। অবসর থাকায় তিনি চলে এসেছেন টিসিবির পণ্য নিতে।

আক্ষেপ করে মো. আতিক বলেন, 'গতকাইল আইসা পাঁচ ঘণ্টা দাঁড়ায়া থাইকা পাই নাই। আজকে ভোর রাইতে আইছি, সকাল হওয়ার আগেই মাইনসের ভিড়৷ এহন আবার সিরিয়াল নেয়া লাগবো। দেখেন কি ঠেলাঠেলি লাগায়। কেউ কারও দিকে মায়া দেখায় না।’

সচরাচর ডিলাররা টিসিবি থেকে পণ্য আনার তিন দিনের মধ্যেই সব বিক্রি করে দেয়। আরও বেশি সময় ধরে এসব পণ্য বিক্রির আবেদন জানিয়ে ওই বৃদ্ধ বলেন, 'প্রত্যেকদিন সিরিয়াল নম্বর ধরে ১০০ জন বা ২০০ জনকে পণ্য দিলে এত ভিড় লাগে না। এখন তো সবাই এক লগে আহে।'20230405_083844

একই স্থানে গতকাল ৮ ঘণ্টা অপেক্ষায় থেকে পণ্য না পেয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরে গেছেন জানিয়ে আরেক বৃদ্ধা আমেনা বেগম (৬০) বলেন, পরে আইসা অনেকে জিনিসপাতি নিয়া গেছে৷ আর আমাগো সময় আসার পর কয় আজকে আর বেচমু না। তাগো মন মর্জি। আমি কাইল সেহেরির পর আইসা লাইনে দাঁড়াইছি। বেলা ১২টা পর্যন্ত দাঁড়াই ছিলাম। এরপরেও সদাই না নিয়াই বাসায় গেছি। চোখের পানি বাজান আটকাইতে পারি না।'

ডিলারদের স্বজনপ্রীতি

ডিলারদের স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছেন বেশিরভাগ ক্রেতা। তারা জানান, সাধারণ ক্রেতাদের একজনকে দুই ফ্যামিলি কার্ডের বেশি পণ্য না দিলেও পরিচিত লোকদের ৫-৭টা কার্ডে পণ্য দেওয়া হয়, তাও সিরিয়াল ভেঙ্গে।

এ বিষয়ে পণ্য নিতে আসা সুমন নামে এক ক্রেতা বলেন, 'প্রত্যেকবারই এই ঘটনা ঘটে। মাঝখান দিয়া কিছু লোক আসে, তাদের আলাদাভাবে দেয়। আর একেকজন আসলে ৭-৮টা করে কার্ড নিয়ে আসে৷ তখন আমরা যারা সেই ভোর থেকে এইখানে দাঁড়ানো তাদের অনেকেরই কিছু না নিয়েই বাসায় ফিরতে হয়।’

এরকম দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও পণ্য না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন আরও অনেক ক্রেতা।

এক ওয়ার্ডের বাসিন্দা অন্য ওয়ার্ডে তালিকাভুক্ত

মিরপুর তিন নাম্বার ওয়ার্ড ৯ নাম্বার রোডের বাসিন্দা শাহানাজ আক্তার। বাসার পাশেই রয়েছে টিসিবি সেল পয়েন্ট (বিক্রয় কেন্দ্র)। তবু প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে ৫ নং ওয়ার্ডের পলাশনগর এসে পণ্যের জন্য ভোর থেকে অপেক্ষা করছেন। কারণ তার ফ্যামিলি কার্ড নিবন্ধন হয়েছে ৫ নাম্বার ওয়ার্ডে। এতে প্রত্যেক মাসেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

শাহানাজ বলেন, 'আমরা ভোটার তিন নাম্বার ওয়ার্ডের, কিন্তু কার্ড দিছে ৫ নাম্বার ওয়ার্ডে। কাগজ জমাও দিছি তিন নাম্বার ওয়ার্ডের কমিশনারের কাছে। সেইখান থেকে কিছু কিছু কার্ড এই ৫ নং ওয়ার্ডে চলে আসছে। খুব কষ্ট হয় এইখানে হেঁটে আসতে।

এই সমস্যা শুধু শাহানাজের একার নয়, মিরপুর ১৩ এর ৩ নং ওয়ার্ড থেকে ১১ এর ৫ নম্বর ওয়ার্ডে টিসিবির পণ্য নিতে এসেছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব বৃদ্ধা কমলা বানু। তাও পণ্য পাওয়া নিয়ে সন্দেহ। কমলা বানু বলেন, 'এইখানে আমার পরিচিত কেউ নাই। খবর পাইয়া আসছি, কিন্তু পণ্য দিবো কি দিবো না এখনও জানি না। ১০টার পর তারা আসলে জানাইবো। সেই অপেক্ষায় আছি।20230405_083741

ডিলারদের স্বেচ্ছাচারিতা ও অসদাচরণ

টিসিবির পণ্য নিতে আসা অধিকাংশ ক্রেতা বয়োবৃদ্ধ ও মহিলা। তাই ডিলাররা কোনও জবাবদিহি ছাড়াই নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী পণ্য বিক্রি শুরু ও বন্ধ করেন। পণ্য বিক্রিতে করেন তাড়াহুড়ো। দুইদিনের মধ্যে পণ্য না নিলে পরে আর বিক্রি করেন না বলে অভিযোগ ক্রেতাদের।

বেশিরভাগ ডিলারই টাঙানো ব্যানারে লিখেন না তাদের ফোন নম্বর। কখন পণ্য বিক্রি শুরু হবে জানতে ফোন করারও উপায় থাকে না ক্রেতার। তাদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে শিকার হন ডিলারদের অসদাচরণের। বিক্রির সময় বিশৃঙ্খলা শুরু হলে ডিলাররা বিক্রি কার্যক্রম বন্ধ করে দেন।

অভিযোগ জানিয়ে পূরবী আধুনিক হাসপাতালের সামনে টিসিবি সেল পয়েন্টে থাকা আসমা আক্তার নামে এক ক্রেতা বলেন, 'তাদের (ডিলার) বিক্রির তাড়া আছে। যত তাড়াতাড়ি বেচতে পারবো তত তাড়াতাড়ি তাদের রেহাই। এই সময়ের মধ্যে জিনিসপত্র নিতে পারলে নেও, তা নাহলে নাই।'

মিরপুর ১১ এর বউবাজার সেল পয়েন্টের আফসার বলেন, 'মাঝে মাঝে কিছু মহিলা মারামারি শুরু করে সিরিয়াল নিয়ে। তখন বিক্রি বন্ধ করে দেয়। মারামারি করে দুইজন আর আমরা যারা সকাল থেকে দাঁড়ানো তাদের শাস্তি পাইতে হয়। ওইদিন জিনিসপত্র না নিয়াই মন খারাপ কইরা বাসায় ফিরি। যদিও তারা বলে সন্ধ্যার পর থেকে দিবে৷ ততক্ষণ কী অপেক্ষা করা যায়।'

পণ্যের মূল্য বেশি রাখার অভিযোগ

সাধারণ মানুষের ভোগান্তিকে পুঁজি করে কোনও কোনও ডিলার দাম বেশি রাখছেন বলে অভিযোগ ক্রেতাদের। তারা বলেন, যেখানে পণ্য পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা সেখানে ১০ টাকা বেশি রাখাতে কী আসে যায়!

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিরপুর বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোর ও তুরাগ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল প্যাকেজ প্রতি ১০ টাকা বেশি রাখে। গতমাসেও রোজার প্যাকেজে ১০ টাকা বেশি রেখেছিল।

অভিযোগে নিয়ে যা বলছে ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন

ক্রেতাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে টিসিবি ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি শেখ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ডিলাররা যেহেতু এলাকার বাসিন্দা তাদেরও কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকে। এলাকার অনেক প্রভাবশালী লোকেরা ফ্যামিলি কার্ড পেয়েছেন, তাদের যদি পণ্য আগে দেওয়া না হয়, অনেক ডিলারই হুমকি-ধমকির শিকার হন। অনেক ডিলার স্বজনপ্রীতি করে এইটাও সত্যি।

পণ্যের ঘাটতি ও অপচয়ের কারণে সবাইকে পণ্য দেওয়া সম্ভব হয় না মন্তব্য করে সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা চাহিদা অনুযায়ী টিসিবি থেকে পণ্য পাই না। আমাদের এখানে ১০ হাজার লোকের রেশনের চাহিদা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ১৮৫০ জনের কম আসছে। এছাড়া টিসিবি থেকে তো বস্তা ধরে আসে। আমরা সেইটা আবার খুচরা ওজন করে বিক্রি করি। মাঝে কিছু পণ্যের ক্ষয় হয়। এতে করেও দেখা যায় ১০-১৫ জন পণ্য পায় না।

তবে পণ্য বিক্রিতে শৃঙ্খলার বিষয়ে অপারগতা স্বীকার করে তিনি বলেন, 'সব এলাকায় বিশৃঙ্খলা হয় না। কোনও কোনও এলাকায় ক্রেতারা শৃঙ্খলা মানে।' এসময় পণ্য বিতরণে ডিলারদেরও আরও দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।