পশুর চামড়ায় লবণ মাখানো জরুরি, তবে...

কোরবানি করা পশুর চামড়ায় লবণ মাখানো জরুরি। কেননা, লবণ না মাখালে চামড়াটি অল্প সময়ের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাবে। কোরবানিদাতা যেন তার কোরবানি দেওয়া পশুর চামড়ায় নিজ খরচে লবণ দিয়ে রাখেন সেই পরামর্শ দিয়েছে সরকার, বিশেষ করে এ কথা উল্লেখ করেছেন সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেছেন, চামড়া একটি জাতীয় সম্পদ। কোরবানিদাতা নিজ ব্যবস্থাপনায় এবং নিজ খরচে এতে লবণ মেখে রাখবেন। কিন্তু একটি গরুর চামড়ায় প্রায় ৩০০ টাকার লবণ মাখানোর পরে সেটি বিক্রি করা যাবে কত টাকায়- এই প্রশ্ন সবার।

উপযুক্ত দাম পাওয়ার জন্য পশুর চামড়া ঠিকভাবে কাটা, ঠিক সময়ের মধ্যে চামড়া বিক্রি করার পাশাপাশি এটি ঠিকমতো সংরক্ষণ করা হচ্ছে কিনা সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। কোরবানির পরে প্রাথমিকভাবে মূলত কাঁচা চামড়া বিক্রি করেন কোরবানিদাতারা। তাদের কাছ থেকে কিনে নেন মৌসুমি চামড়া সংগ্রহকারীরা। কিন্তু কোরবানির পশুর ক্ষেত্রে কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণের পরিবর্তে প্রতিবছর লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়। আড়তদার বা ট্যানারিগুলো লবণের দাম ও শ্রমিকের মজুরি বাদ দিয়ে মৌখিকভাবে কাঁচা চামড়ার দরদাম ঠিক করেন। এ কারণে অনেকে কাঁচা চামড়ার ন্যায্য দাম না পাওয়া নিয়ে অভিযোগ করেন। সে কারণেই অনেকে চামড়ায় লবণ মাখানোর কাজটি করেন না।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাণিজ্যিকভাবে মাংস বিক্রির উদ্দেশ্যে জবাই করা প্রতিটি গরুর চামড়া (বড় চামড়া ৩৫ থেকে ৪০ বর্গফুট) প্রক্রিয়াজাতকরণে গড়ে ৮ থেকে ৯ কেজি লবণ লাগে। তবে কোরবানি দেওয়া পশুর চামড়ায় লবণ লাগে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৪ কেজি। কোরবানির পশুর চামড়া বেশিরভাগই অপরিপক্ব হাতে ছাড়ানো হয়, এতে চামড়ায় মাংস থেকে যায়। অনেক সময় চর্বিও থেকে যায়। এ কারণেই কোরবানির পশুর চামড়ায় লবণ বেশি লাগে। তা না হলে চামড়ায় লেগে থাকা মাংস ও চর্বি পচে চামড়াটি নষ্ট হয়ে যায়।

কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ও বিএইচএসএমএ সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান জানিয়েছেন, ৩৫ থেকে ৫০ বর্গফুটের বড় আকারের একটি চামড়া সংরক্ষণের জন্য ৮ থেকে ৯ কেজি লবণ প্রয়োজন হয়। আর চামড়ার আকার ৫৫ থেকে ৬০ বর্গফুট হলে লবণ লাগে ১০ কেজির মতো। অন্যদিকে, মাঝারি (২২-২৫ বর্গফুট) আকারের একটি চামড়ার জন্য ৫ থেকে ৬ কেজি লবণ প্রয়োজন হয়। আর ছোট ১৫ থেকে ১৬ বর্গফুট চামড়ার জন্য লবণ লাগে ৩ থেকে ৪ কেজি। এছাড়া এক কেজি লবণ দিয়ে দুইয়ের বেশি ভেড়া, ছাগল বা খাসির চামড়া সংরক্ষণ করা যায় বলে জানান তিনি।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রোজার আগে পাইকারি বাজারে ৬০ কেজি ওজনের প্রতিটি লবণের বস্তা সাড়ে ৫০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন সেটি ৯০০ থেকে ৯২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এই হিসাবে প্রতিটি গরুর চামড়ায় লবণ দিতে হবে (১৪ কেজি) ২৩০ থেকে ২৫৫ টাকার। এখানেই শেষ নয়। একজন কোরবানিদাতা যখন লবণ কিনবেন তখন তিনি আর ৬০ কেজির বস্তা কিনবেন না। তিনি কিনবেন খুচরা দোকান থেকে কেজি দরে মোটা দানার লবণ। যা প্রতিকেজি বিক্রি হয় ২৫ টাকা দরে। এই হিসেবে একটি চামড়ায় লবণ দিতে কোরবানিদাতার খরচ হবে ৩০০ টাকার ওপরে।

এ বছর ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। গত বছর এই দাম ছিল ৪৭ থেকে ৫২ টাকা। আর ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। গত বছর ছিল ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। তবে গরুর দাম বাড়লেও খাসি ও বকরির চামড়ার দাম বাড়েনি। আগের মতোই খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকায় বিক্রি হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে চামড়ার এই দাম নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, অনেক ট্যানারি মালিকে নিজেরাই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কাঁচা চামড়া সরাসরি কিনলেও প্রাথমিকভাবে কোরবানিদাতা ব্যক্তি অথবা মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানার চামড়া সংগ্রহকারী কিংবা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে কাঁচা চামড়া যায় আড়তদারদের কাছে। এরপর এসব চামড়ায় লবণ মিশ্রিত করে সাময়িকভাবে সংরক্ষণ করা হয়। অনেকেই চামড়া বেশি দামে বিক্রির আশায় এক বাজার থেকে অন্য বাজারে ঘোরেন। এতে চামড়ার স্থায়িত্ব নষ্ট হয়। কোরবানির পশুর চামড়া ঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় প্রতিবছর অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়। এ জন্য কোরবানির পশুর চামড়া ছাড়ানোর ৪ থেকে ৯ ঘণ্টার মধ্যে লবণ দিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত বলে মনে করেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। এই সময়ের মধ্যে লবণ দেওয়া না গেলে ওই চামড়া নষ্ট হয়ে যায়।

এদিকে ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে দেশের সর্বত্রই লবণের চাহিদা ও সরবরাহ বেড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এই সুযোগে দাম বাড়িয়েছেন একশ্রেণির মুনাফাখোর ব্যবসায়ী। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। লবণের দাম নিয়ে কারসাজি করলে শুধু জরিমানা নয়, মামলাও করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জানিয়েছেন, চামড়া নিয়ে যাতে কোনও খবরের শিরোনাম না হয় তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কোরবানির পশুর চামড়া জাতীয় সম্পদ। তাই এবার চামড়া সংরক্ষণে ভোক্তা অধিদফতরের অভিযান কঠোর হবে। দেশে চাহিদার তুলনায় বহুগুণ বেশি লবণ আছে।

সরকারের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, দেশে মোট লবণের চাহিদা ২৩ লাখ টন। কোরবানির ঈদে লাগে ১ লাখ টনের কম। মজুদ রয়েছে সাড়ে ৩ লাখ টন। তারপরও ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা লবণের বস্তা ১১০০ টাকা হয়ে গেছে। প্রতি বস্তায় ৭৫ কেজি লবণ থাকে। প্রতি কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকার বেশি হবে না। দেশে যথেষ্ট লবণের মজুত রয়েছে। চামড়া ব্যবসায়ীরা ৮০ শতাংশ লবণ সংগ্রহ করেছেন। তাই কোনোক্রমেই লবণের বেশি দাম নেওয়া যাবে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি পরিতোষ কান্তি সাহা জানিয়েছেন, দেশে বর্তমানে লবণের চাহিদা ৩০ লাখ টন। কিন্তু সরকার ২৩ লাখ টন বলছে। কিন্তু বাস্তবে ঘাটতি রয়েছে। শুধু মোটা লবণের দাম কিছুটা বেড়েছে। সেটা আমদানি হলে কমে যাবে।