এবারও কাঁচা চামড়ার কদর নেই

২০১৭ সালের পর থেকে কাঁচা চামড়ার কদর কমেছে। এবারও একই দশা। রাজধানীসহ সারাদেশেই কাঁচা চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কোরবানিদাতারা। অবশ্য কোরবানিদাতাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মাদ্রাসায় বিনামূল্যে চামড়া বিতরণ বেড়েছে যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি। রাজধানীর অধিকাংশ মহল্লার মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।

বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) ঈদের দিন সকাল থেকে রাজধানীর অলিগলিতে দেখা যায়— বৃষ্টির মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা চামড়া সংগ্রহ করছে। একইভাবে রাজধানীর পোস্তা এলাকায় আড়তগুলোতে সংগ্রহ করা চামড়া জমা দিতে দেখা যায় বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের।

বেশ কয়েকজন কাঁচা চামড়ার আড়তদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, ফড়িয়া বা মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের জায়গায় এখন বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা স্থান করে নিয়েছে। আড়তদারদের বক্তব্য হলো- পুঁজির অভাবে রাজধানীর অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ী চামড়া সংগ্রহ করা ছেড়ে দিয়েছেন। শুধু রাজধানীই নয়, গ্রামগঞ্জেও অনেক ফড়িয়া চামড়া কেনা ছেড়ে দিয়েছেন। পাবনার ভাঙ্গুরার রইস উদ্দিনের নেশা ছিল কোরবানির মৌসুমে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে আড়তে বিক্রি করা।

গত দুই বছর তিনি আর এই ব্যবসা করছেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ২০১৭ সালের পর থেকে চামড়ার দাম এতো কমে গেছে যে কোনও লাভ হয় না। তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৭ সালের আগে  চামড়ার যে কদর ছিল গত কয়েক বছর ধরে তা নেই।

রাজধানীর শুক্রাবাদ এলাকার জমসেদ আকবর জানান, তিনি আগে মৌসুমি কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ী ছিলেন। সাত আট বছর আগে তার কদর ছিল হাজারীবাগে। তখন ট্যানারির  মালিকরা  তাদেরকে কিছু টাকা অগ্রিম দিতেন। এই টাকার সঙ্গে আরও টাকা দিয়ে চামড়া কিনে সেগুলো আগের নির্ধারিত দামে ট্যানারিতে বিক্রি করতেন। কিন্তু বর্তমানে এই অবস্থা নেই বলে জানান তিনি। চামড়ার সেই কদর নেই।  তিনি বলেন, ২০১৫ সালের আগে বেশ কয়েকবার তিনি প্রতিটি গরুর চামড়া গড়ে ২০০০ টাকায় কিনে ৩০০০ টাকায় ট্যানারিতে বিক্রি করেছেন।

মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বুঝে-শুনে চামড়া কেনার পরামর্শ দিয়েছেন পুরান ঢাকার পোস্তার কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিনস মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ)  সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. টিপু সুলতান।

তিনি বলেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া লবণযুক্ত চামড়া দামের চেয়ে বেশি দামে চামড়া কিনা ঠিক হবে না। মৌসুমি ব্যবসায়ীদেরকে বলবো, তারা যেন অবশ্যই এর চেয়ে কম রেটে কাঁচা চামড়া কিনেন। করণ মাঝারি আকারের একটি গরুর চামড়া সংরক্ষণে ৮ থেকে ৯ কেজি লবণ লাগে। এর সঙ্গে শ্রমিকদের মজুরি ও গোডাউন ভাড়া আছে।

এদিকে বৃষ্টির কারণে চলতি বছর ৫ থেকে ১০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে  বলেন,  বৃষ্টির কারণে ৫ থেকে ১০ শতাংশ চামড়া অবশ্যই নষ্ট হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যবসায়ীরা চামড়াগুলো সঠিক সময়ে সংরক্ষণ না করলে সেখানেও চামড়া নষ্টের সম্ভাবনা রয়েছে। বৃষ্টির কারণে চামড়ার মান দ্রুত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় রাত ১০টার মধ্যে বেচাকেনা শেষ করে তা সংরক্ষণ করার আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে আসেন সংগ্রহকারীরা। দাম পাওয়া, না পাওয়া নিয়ে বিক্রেতারা জানিয়েছেন মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তারা বলেন, কেউ কেউ ভালো দামে বিক্রি করলেও; অনেকেই বেশ সস্তায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। মূলত ক্রেতাদের পাশাপাশি মূল্যবান এই সম্পদ সংগ্রহের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

রাজধানীর সাইন্সল্যাব এলাকার চামড়া বিক্রি করতে এসেছেন আজহার। তিনি জানান, বিগত বছরের মতো এবারও চামড়ার ন্যায্য দাম মিলছে না। বড় সাইজের গরুর প্রতি পিস চামড়া ৮০০ টাকা ও মাঝারি সাইজের গরুর প্রতিপিস চামড়া ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

তবে যারা দেশের সবচেয়ে বড় চামড়ার আড়ৎ পুরান ঢাকার পোস্তায় মূল্যবান এই সম্পদ বিক্রি করতে আসছেন; তাদের কেউ কেউ জানান ভালো দাম পাওয়ার কথা। আবার অনেকেই দাবি করেন, এবারও তারা লোকসান গুনছেন।

অর্থাৎ ভালো দাম না পাওয়ার জন্য যেমন ট্যানারি মালিক বা চামড়ার আড়ৎদার ও পাইকারদের দোষ দিচ্ছেন তেমনি বছরের এই একটি দিনে বড় পরিসরে চামড়া সংগ্রহে অব্যবস্থাপনা আর সরকারের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন অনেকে। রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় চামড়ার দাম মাত্র ২০০ বা ৩০০ টাকা বলছেন ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা। এ জন্য কোরবানিদাতারা বাধ্য হয়ে  চামড়া এতিমখানায় দিয়ে দিয়েছেন। যদিও কোরবানিদাতাদের অনেকের মন্তব্য— কোরবানির পর চামড়া কিনতে আসছেন না কোনও ব্যবসায়ী। কোনও কোনও এলাকায় দুয়েকজন মৌসুমি ব্যবসায়ীকে পাওয়া গেলেও দাম বলছেন খুবই কম। গরুর চামড়া আকারভেদে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বলছেন।

এদিকে সায়েন্স ল্যাবরেটরির ফুটপাতের খোলা হাটে দেখা যায়  বড় গরুর চামড়া হলে ৬০০ টাকা, মাঝারি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। ছোট্ট ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।

নাজমুল আহমেদ নামে একজন ক্রেতা জানান, তিনি এপেক্স ট্যানারিসহ আরও দুটি ট্যানারিতে চামড়া সরবরাহ করেন। তিনিও বড় গরুর চামড়া হলে ৬০০ টাকা, মাঝারি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কিনছেন। আর ছোট গরুর চামড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় কিনছেন। বেশ কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী মিনি ট্রাক বোঝাই করে কাঁচা চামড়া নিয়ে আসেন সাইন্স ল্যাবের হাটে। তবে দাম কম বলায় বিক্রি না করে তারা পোস্তার দিকে রওনা দেয়।

এদিকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চামড়া কেনার মানুষ পাচ্ছেন না কোরবানিদাতারা।  ফড়িয়া ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চামড়া কিনে মূল বাজারে তা বিক্রি করতে পারবেন কি না, সেই শঙ্কা রয়েছে। গত বছর যে দামে তারা মাঠ পর্যায় থেকে চামড়া কেনেন তার অর্ধেক দামে আড়তে বিক্রি করত হয়। সেই লোকসানের আশঙ্কাতেই এবার অনেকেই মাঠে নেই। তবে  নগদ টাকার সংকটের কারণে অনেক ব্যবসায়ী ঝুঁকি নিচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন অনেকে।