অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানি কমে যাওয়া, ওইসব দেশগুলোতে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, বেসরকারি পর্যায়ে জনশক্তি রফতানিতে অনীহার কারণে রেমিটেন্স প্রবাহ অব্যাহতভাবে কমছে। এছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়ায় প্রবাসীরা এখন আর আগের মতো অর্থ দেশে পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আর্ন্তজাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমে যাওয়ার কারণে প্রবাসীরা আগের তুলনায় তাদের আয়ের টাকা কম পাঠাতে পারছেন। এতে রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো সংকটে পড়তে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোতে এখন আয় কমে গেছে। যার ফলে সেখানকার শ্রমিকদেরও আয় কমে গেছে।’ আগামী মাসগুলোতেও রেমিটেন্স প্রবাহ কমতে থাকবে বলে মনে করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে গত ফেব্রুয়ারিতে ১১৩ কোটি ১৪ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। জানুয়ারিতে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন ১১৫ কোটি ১৯ লাখ ডলার। আগের মাস জানুয়ারির তুলনায় যা এক কোটি ৯২ লাখ ডলার কম। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির তুলনায় পাঁচ কোটি ৮২ লাখ ডলার কম।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সিনিয়র গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আর্ন্তজাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানি কমে যাওয়ায় প্রবাসী আয় কমেছে। এছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়ায় প্রবাসীরা এখন আর আগের মতো অর্থ দেশে পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছেন না।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত কয়েক মাস ধরেই রেমিটেন্স প্রবাহ কমছে। ২০১৪ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬৮ শতাংশে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসের তুলনায় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে রেমিটেন্স প্রবাহ কমেছে প্রায় ১৬ কোটি ডলারের সমপরিমাণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে আগের অর্থবছরের ৮ মাসের তুলনায় রেমিটেন্স কমেছে এক দশমিক শুন্য ৫৪ শতাংশ। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মোট ৯৭৬ কোটি ৯২ লাখ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। আগের অর্থবছরের একই সময়ে পাঠানো অর্থের পরিমাণ ছিল ৯৯২ কোটি ডলার। এ হিসেবে একই সময়ের তুলনায় রেমিটেন্স কমেছে ১৫ কোটি আট লাখ ডলার। অর্থাৎ এক দশমিক ৫৪ শতাংশ কমেছে। গত জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে রেমিটেন্স কমেছিল ৯ কোটি ১২ লাখ ডলার যা এক দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। বর্তমানের এ ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য হারে কমবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টার প্রেস নেটওয়ার্কের সিনিয়র গবেষক আনোয়ারুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রবাসী শ্রমিকদের একটা বড় অংশ রয়েছে জ্বালানি তেল নির্ভর দেশগুলোতে। এই দেশগুলোতে শ্রমিকরা নির্ধারিত কাজের পাশাপাশি ওভারটাইম বা অতিরিক্ত কাজ করতো। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিশেষ করে জ্বালানি তেলনির্ভর দেশগুলোতে কিছু দিন ধরে আয় কমে গেছে। যার ফলে ওই সব দেশে অবস্থানকারী শ্রমিকদেরও আয় কমেছে। যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক রেমিটেন্স প্রবাহের ওপর।’
এর আগে দীর্ঘ তের বছর পর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবাসী আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় ২ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা এক দশমিক ৬১ শতাংশ কমেছিল।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিভিন্ন দেশে প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। তাদের সিংহভাগই শ্রমিক, যারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে আছেন এক লাখের কিছু বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চার বছরের জানুয়ারি মাসের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সবচেয়ে কম রেমিটেন্স এসেছে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ১১৫ কোটি ১৯ লাখ ডলার। ২০১৫ সালে ১২৪ কোটি ৩২ লাখ, ২০১৪ সালে ছিল ১২৬ কোটি ৬ লাখ ও ২০১৩ সালে তারা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ১৩২ কোটি ৬৯ লাখ ডলার।
/এজে/