বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরি

পদত্যাগ করবেন গভর্নর?

বাংলাদেশ ব্যাংক-ড. আতিউর রহমানবাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পদে পরিবর্তন আনা হচ্ছে—এমন গুঞ্জন এখন সারাদেশে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বড় পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন সোমবার দিনের বেলাতেই। এদিন সন্ধ্যায় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে গভর্নর ড. আতিউর রহমানের গুরুত্বপুর্ণ বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত হয়নি। রাতে গভর্নর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হননি। সব জায়গায় এখন একই সুর গভর্নরের ওপর ক্ষুব্ধ  সরকারের শীর্ষ মহল। এমনও শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরি যাওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন। আর যদি তাই হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নতুন গভর্নর হিসাবে নিয়োগ পেতে পারেন সাবেক অর্থ সচিব ড. মোহাম্মদ তারেক। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, শুধু যে  গভর্নরের পরিবর্তন হচ্ছে তা নয়, ঢেলে সাজানো হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকেও। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে দুজন নতুন সদস্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তারা হলেন, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম রহমান। রবিবার সন্ধ্যায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে।

২০০৯ সালের ১ মে ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে আতিউর রহমানের মেয়াদ প্রায় সাড়ে তিন বছর বাড়ানো হয়। তার বয়স ৬৫ হওয়া পর্যন্ত চাকরির এ মেয়াদ বাড়ানো হয়। অর্থাৎ ২০১৬ সালের ২ আগস্ট পর্যন্ত গভর্নর পদে আতিউর রহমানকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।

ড. আতিউর রহমান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগদানের পর থেকে ব্যাংক খাতে সুশাসন অভাব প্রবল আকার ধারণ করে। তার আমলে হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা ধরণের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। শেয়ার বাজারের কয়েক লাখ বিনিয়োগকারীও মনে করেন, ড. আতিউর রহমানের কারণে শেয়ারবাজার আজ ধ্বংসের মুখে। তার আমলেই সবচেয়ে আলোচিত রিজার্ভ থেকে টাকা চুরি ঘটনা ঘটে। শুধু ঘটনা ঘটেছে তাই নয়, রিজার্ভের এই টাকা চুরি হওয়ার তথ্য গোপন করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ঘটনায়  কেবল অর্থমন্ত্রীই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চরম ক্ষুব্ধ ছিলেন। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা লোপাটের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের দায় এড়ানোর কোনও সুযোগ নেই।  রবিবার সন্ধ্যায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সংক্রান্ত দলের মনোনয়ন বোর্ডের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার আসল রহস্য কী, তাও উদঘাটন করতে হবে। এ চেষ্টায় কারা জড়িত তাও খতিয়ে দেখা হবে।

এই ঘটনায় ব্যাংকিং খাতে পরিবর্তন আসছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ডেফিনেটলি দেয়ার উড বি চেইঞ্জেস। এত বড় একটা সিরিয়াস ব্যাপার। আই টেক ইট ভেরি সিরিয়াসলি। সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এই পরিবর্তনের কথা বলেন। এর আগে রবিবারও অর্থমন্ত্রী বলেন, রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘বিষয়টা দুই মাস আগে ঘটলেও আমাকে জানানো হয়নি। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ। পুরো বিষয়টি নিয়ে আমি খুবই অখুশি।  একই ধরনের মন্তব্য করেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলম। তিনি বলেন, অর্থ চুরির ঘটনাটি ঘটেছে ৫ ফেব্রুয়ারি। এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড সভা হয়েছে। ২৯ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট কমিটির সভা হয়েছে। কিন্তু কোনও  সভাতেই বিষয়টি তাকে জানানো হয়নি। তিনি বলেন, আমি মনে করি, এটা অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের আমাদের ও সরকারকে জানানো উচিত ছিল। 

এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লোপাটের প্রেক্ষাপটে  মঙ্গলবার সকাল ১১ টায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুষ্ঠিতব্য জরুরি বোর্ডসভাও স্থগিত করা হয়েছে। 

এর আগে রবিবারই  বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে বলে গত দুদিন ধরে গুঞ্জণ ছিল মিডিয়া পাড়া এবং মতিঝিলের ব্যাংক পাড়ায়। সেই গুঞ্জনের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রীর একটি বক্তব্য যোগ হওয়ায় আতিউর রহমানকে সরে যেতে হচ্ছে এমন পালে জোরসে বাতাস বইতে থাকে। অবশ্য জাতীয় সংসদের বাইরে থাকা দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি আতিউর রহমানের পদত্যাগ দাবি করে। পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘদিন ধরেই গভর্নরের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।

প্রসঙ্গত, গত ৫ ফেব্রুয়ারি  বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম থেকে অর্থ স্থানান্তরের  যে সংকেতলিপি (সুইফট কোড) ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের কাছে পাঠানো হয়েছিল, তা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকেরই কোড। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোড ব্যবহার করেই ১০১ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তরিত হয়ে যায় ফিলিপাইনে। শ্রীলঙ্কার একটি ব্যাংকে আরও ২০ মিলিয়ন ডলার সরানো হলেও বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হওয়ায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়।

/এমএন এইচ/