জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের মধ্যে এখন কার্যত মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে। একদিকে আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি আদায়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছেন, অন্যদিকে সরকারও কর্মস্থলে অনুপস্থিতি ও অফিস কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে রাজস্ব প্রশাসনসহ সরকারি সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। এমন এক সময়ে এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, যখন নতুন অর্থবছরের সূচনা ও বাজেট বাস্তবায়নের প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে।
২৮ জুন থেকে লাগাতার কর্মবিরতি: পরিষদের ঘোষণা
শুক্রবার (২৭ জুন) এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি অতিরিক্ত মহাপরিচালক হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার এবং মহাসচিব অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা ঘোষণা দেন যে, আগামীকাল শনিবার (২৮ জুন) থেকে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের আওতাধীন সব দফতরে ‘লাগাতার কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি কার্যকর হবে। একইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ‘শান্তিপূর্ণ মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি পালিত হবে।
তারা দাবি করেন, এই আন্দোলন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, যুক্তিসম্মত এবং রাজস্ব ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে।
চেয়ারম্যান অপসারণসহ ৫ দফা দাবি
আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে— এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ; এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কার; প্রশাসনিক দক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ; চলতি বদলির আদেশ বাতিল ও কর্মকর্তা নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত এবং ‘রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ সংশোধন।
পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়, জনসাধারণের দুর্ভোগ বিবেচনায় আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা শাটডাউনের আওতামুক্ত থাকবে। তবে অন্যান্য দাফতরিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
সরকারের পাল্টা প্রতিক্রিয়া: শৃঙ্খলা লঙ্ঘনে শাস্তির হুঁশিয়ারি
অন্যদিকে সরকার ও এনবিআর কর্তৃপক্ষ এই আন্দোলনের ফলে দফতরীয় সেবা ব্যাহত হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আল-আমিন শেখের সই করা এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনুপস্থিতি বা অফিসে বিলম্বে আসা সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একইসঙ্গে মাঠ পর্যায়ের কাস্টমস হাউস, কর কমিশনারেট ও ভ্যাট কমিশনারেটে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে দফতর ত্যাগের ক্ষেত্রেও অনুমতি ও রেজিস্টারে এন্ট্রি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আলোচনা প্রস্তাব ও সংলাপে অনুপস্থিতির অভিযোগ
২৬ জুন অর্থ উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধি না থাকায় কিছু অগ্রগতি হলেও তা নেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
সংগঠনের অভিযোগ, তাদের ওই সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সেক্ষেত্রে তাদের অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে, সেটি একতরফা।
তবে তারা আলোচনার জন্য এখনো প্রস্তুত বলে জানিয়ে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার ‘সানুগ্রহ হস্তক্ষেপ’ কামনা করেছে।
সরকারের তিন সিদ্ধান্ত: আশাবাদী হলেও বাস্তবায়ন অনিশ্চিত
সরকারি বিবৃতিতে জানানো হয়, আলোচনার মাধ্যমে অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো হলো কর্মসূচি প্রত্যাহার; বদলির আদেশ পুনর্বিবেচনা এবং ১ জুলাই বিকাল ৪টায় সংশোধনী আলোচনায় আহ্বান।
৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অধ্যাদেশ সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশাবাদও প্রকাশ করেছে সরকার।
তবে আন্দোলনকারীরা বলছেন, শুধু ঘোষণায় আস্থা নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত কার্যকর সিদ্ধান্ত ও অংশগ্রহণমূলক সংলাপ না হয়, আন্দোলন চলবে।
মুখোমুখি অবস্থান, জটিলতা বাড়ছে
সরকার ও এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে যেভাবে পরস্পরবিরোধী অবস্থান তৈরি হয়েছে, তাতে অচলাবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একদিকে শাটডাউনে রাজস্ব আহরণ ও সেবা কার্যক্রম থমকে যাওয়ার আশঙ্কা, অন্যদিকে সরকারের কঠোর বার্তা ও শাস্তির হুঁশিয়ারি— উভয়ের অবস্থান থেকে আপাতত সমঝোতার পথ সুগম হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ও সর্বপক্ষীয় আলোচনাই হতে পারে উত্তরণের একমাত্র পথ।