‘তুমি গ্রামের মানুষ, তাই ঋণ দিমু না’

বাংলাদেশ ব্যাংকরাজশাহীর বাঘা উপজেলার আশ্রাফপুর গ্রামের আবদুস সালাম। চাকরি না করে তিনি ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স আবদুস সালাম তিলে-তিলে গড়ে তোলেন মা-মনি কোল্ড স্টোরেজ। তিনি এই কোল্ড স্টোরেজের নামে ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ব্যাংক ঋণের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইএফ ফান্ডের এই ঋণ আজও তিনি পাননি। ১২ কোটি টাকা ঋণের জন্য তিনি টানা সাড়ে তিন বছর জুতার তলা ক্ষয় করেছেন। ঋণ পাওয়ার আশায় ইতোমধ্যে তিনি প্রায় ৩২ লাখ টাকা খরচও করেছেন। কিন্তু তার কপালে ঋণ জোটেনি। ২০১৫ সালের জুনে এসে ব্যাংক কর্মকর্তারা তাকে সাফ বলে দিয়েছেন ‘তুমি গ্রামের মানুষ, তাই ঋণ দিমু না’।
ব্যাংক গ্রামের মানুষকে ঋণ দিতে চায় না—তার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তৈরি করা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতি ১০০ টাকার মধ্যে গ্রামের মানুষ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন মাত্র ৯ টাকা ৮৫ পয়সা। এই তথ্য ২০১৫ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকের। তিন মাস আগে অর্থাৎ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রতি ১০০ টাকার মধ্যে গ্রামের মানুষ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারতেন ৯ টাকা ৮৮ পয়সা। ৬ মাস আগে অর্থাৎ ২০১৫ সালের জুন প্রান্তিকে গ্রামের মানুষ ঋণ নিতে পারতেন ১০ টাকা। এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দিন যত যাচ্ছে, গ্রামের মানুষের ঋণ পাওয়ার পরিমাণ ক্রমেই কমছে।

এ প্রসঙ্গে নাটোরের আশ্রাফপুর গ্রামের আবদুস সালাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঋণের জন্য টানা সাড়ে তিন বছর চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পেয়েছি। কিন্তু ঋণ পাইনি। ব্যাংক কর্মকর্তারা আমাকে সাফ বলে দিয়েছেন ‘তুমি গ্রামের মানুষ, তাই তোমাকে ঋণ দিমু না’। আবদুস সালাম জানান, মা-মনি কোল্ড স্টোরেজের নামে ঋণ পাওয়ার জন্য দিন-রাত চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাংক থেকে একটাকাও ঋণ পাইনি। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে প্রতি ১০০ টাকার মধ্যে ৯০ টাকা ১৫ পয়সা নিয়েছে শহরের মানুষ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে শহরের শিল্পপতিরা নিয়েছেন ৫ লাখ ২২ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। আর বাকি ৫৭ হাজার ১২৬ কোটি টাকা নিতে পেরেছেন গ্রামের মানুষ।

এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউট অব মাইক্রো ফিন্যান্সের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক এমএ বাকী খলিলি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ ব্যাংক থেকে ঋণসেবা পান। ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শহরের পাশাপাশি ধনী ও উচ্চ উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে বেশি  গুরুত্ব দেয়। এ কারণে ব্যাংকের সংখ্যা ও শাখা বাড়লেও সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা বাড়ছে না। একটি  বেসরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, শ্রমিকদের ২৫ শতাংশ কোনও জায়গা থেকে ঋণ পান না। আর ৪২ শতাংশ মানুষ মনে করেন, তারা ঋণ পাওয়ার জন্য উপযুক্ত নন।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টার প্রেস নেটওয়ার্কের (আইপিএন) সিনিয়র গবেষক আনোয়ারুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গ্রামের মানুষ ভোগান্তির কথা চিন্তা করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চান না। কিন্তু বিভিন্ন উপলক্ষ সামনে রেখে তারা ব্যাংকে টাকা জমান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামের মানুষ চাহিদা মতো ঋণ সুবিধা না পেলেও তাদের টাকায় ব্যবসা করছে ব্যাংকগুলো। ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে মোট আমানতের ১৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ ব্যাংকে জমা রেখেছেন গ্রামের মানুষ। যা টাকার অংকে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি মালিকানার ৫৬টি ব্যাংকের শাখা রয়েছে ৯ হাজার ৩৯৭টি। এর অধিকাংশই স্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরে। ঋণ সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে এসব জেলা ও উপজেলা শহরের লোকদের।

প্রসঙ্গত, দেশের পাঁচ হাজারের বেশি ইউনিয়ন থাকলেও এইসব এলাকায় ব্যাংকের শাখা নেই। এ কারণে ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বা আর্থিক সেবা বাড়ছে না। আবার শহর ও অল্প কিছু অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ায় অন্য অঞ্চলে বড় কোনও শিল্প গড়ে উঠছে না। আর এ কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে না।

/এমএনএইচ/আপ-এনএস/