চামড়া নিয়ে এই সংকট আর কতকাল?

মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে চামড়ার অবদান এখন মাত্র শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। রয়েছে এ খাতের জন্য দক্ষ শ্রমিকের অভাব। প্রশ্ন রয়েছে নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিয়েও। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তির বিষয়টিও প্রশ্নের মুখোমুখি। তাইতো চামড়া নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে সংশ্লিষ্টদের। অথচ বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্যের তালিকায় থাকা তৈরি পোশাকের পরেই চামড়ার অবস্থান দ্বিতীয়। 

খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চামড়া খাতের উন্নয়নে দরকার একটি শিক্ষিত উদ্যোক্তা শ্রেণী। দরকার সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা। দরকার নিরাপদ কর্ম পরিবেশ ও ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন। প্রয়োজন দক্ষ পর্যাপ্ত শ্রমিক। এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা পাওয়া গেলে এ খাতের উন্নয়ন খুব বেশি দূরে নয়। এমনটাই জানিয়েছেন তারা।   

দেশের চামড়া খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের চামড়ার মান অন্যান্য দেশের তুলনায় উন্নত। তার পরেও এ খাতের অবস্থা এমন কেনো? বিশেষজ্ঞদের অভিমত এ খাতের উন্নয়নে একটি শিক্ষিত উদ্যোক্তা শ্রেণী দরকার। দরকার সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা। এছাড়া এ খাতের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাফল্যের মুখ দেখাটা সময় সাপেক্ষ। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না হলে, উপযুক্ত বেতন কাঠামো প্রণীত না হলে এ খাতের সফলতা অর্জন অনেকটাই কষ্টসাধ্য হবে।

জানা গেছে, নানা ধরণের জটিলতায় এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। কোনোভাবেই এ খাতের শ্রমিকদের কাজের প্রতি আগ্রহী করা যাচ্ছে না। যারা একাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন তারা অনেকটাই দায়ে পড়ে আছেন। অন্য কাজের অভিজ্ঞতা নেই বলে নানা ঘাত-প্রতিঘাত-সীমাবদ্ধতা নিয়ে আছেন এই কাজের সঙ্গে। আর্থিক সংকট, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, ন্যায্য পাওনা না পাওয়া, আবাসন সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন চামড়া শিল্পে।  

পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রম জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে এ খাতে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার, যা মোট কর্মসংস্থানের শূন্য দশমিক ২২ শতাংশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ খাতে রফতানি আয় ছিল ১১২ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭-তে এসে তা বেড়ে ১২৩ কোটি ডলার হয়। তবে পরের দুই অর্থবছরে চামড়া শিল্পের রফতানি আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা নেমে আসে ১০৮ কোটি ডলারে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরও কমে হয়েছে ১০২ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরও কমে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরের এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার। যদিও এই অংক গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। গত এক বছরে এ খাতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশের মতো। 

জানা গেছে, বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রধান বাজার ইউরোপের দেশগুলোয় করোনার প্রাদুর্ভাব কমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে শুরু করায় চাহিদা বেড়ে রফতানিতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

তৈরি পোশাকের পর বাংলাদেশের প্রধান রফতানিপণ্য হচ্ছে চামড়া। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই দেশের চামড়ার বাজারে বিরাজ করছে ব্যাপক অস্থিরতা। লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র তিন শ টাকায়। এমনকি ন্যায্য দাম না পেয়ে গতবছর কোরবানির পশুর চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। এ বছর এমন খবর পাওয়া না গেলেও লবণ দিতে দেরি করায় পঁচে যাওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে।  অতীতে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী পাড়া-মহল্লা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করতে এনে চামড়ার ক্রেতা না পেয়ে রাস্তায় ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ জানা গেছে, লবণ দিতে দেরি করায় চামড়া পঁচে গেছে।  

খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ষাটের দশকে যাত্রা শুরু করা চামড়া শিল্প এখনও পর্যন্ত খুব একটা সামনে এগোয়নি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নানা ধরণের সুবিধা পেয়ে আশির দশকে যাত্রা শুরু করা তৈরি পোশাক অর্থনীতির অন্যতম ভিত হতে পেরেছে, শিক্ষিত ও স্বপ্নবাজ উদ্যোক্তা শ্রেণীর জন্য। অথচ চামড়া খাত অনেকটাই আগের অবস্থানে পড়ে আছে। পোশাক খাতে শ্রমিকরা যাতে কাজে আগ্রহী হয়, সেজন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশে তৈরি ও ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু চামড়া শিল্পের শ্রমিকদের জন্য এখনও নিশ্চিত করা যায়নি নিরাপদ কর্মপরিবেশ। অপরদিকে এ শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য এখনও কোনও বেতন কাঠামো তৈরি হয়নি। ফলে দীর্ঘ সময়েও সুবিধাজনক স্থানে দাঁড়ায়নি চামড়ার অর্থনীতি।

চামড়া শিল্পের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে সাভারে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক চামড়া শিল্প নগরী। প্রত্যাশা ছিল সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে কারখানাগুলো উৎপাদনে গেলে রফতানি আয় বাড়বে। কারখানাগুলো হাজারীবাগ থেকে স্থানান্তর হলেও এই সময়ে উল্টো রফতানি আয় ধারাবাহিকভাবে কমেছে। হাজারীবাগের আড়াই শ কারখানার মধ্যে সবগুলো নয়, দেড়শ কারখানাকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। দীর্ঘ সময় পার করেও  নগরীটির কাজ এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। এখনও পর্যন্ত নানা জটিলতায় সেখানকার কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারটি পুরোপুরি চালু করা যায়নি। ফলে ট্যানারিগুলো থেকে আসা বর্জ্য খোলা আকাশের নিচে ফেলায় বুড়িগঙ্গার পর এখন দূষিত হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীর পানি। এর প্রভাবে বিষাক্ত হয়ে উঠছে সেখানকার পরিবেশ।

এ দিকে কোরবানির ঈদ এবং তার সঙ্গে কাঁচা চামড়ার সরবরাহের সম্পর্ক অনেক দিনের। এর সঙ্গে অর্থনীতির যোগ বেশ নিবিড়।

সংশ্লিষ্ট তথ্যে দেখা যায়, দেশে প্রায় ৩১৫ মিলিয়ন স্কয়ার ফুট ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়ার সরবরাহ রয়েছে, তার একটি বিশেষ অংশই আসে কোরবানির সময়। চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ায় পুরো লাভটাই যাচ্ছে আড়তদার, ব্যবসায়ী আর ট্যানারি মালিকদের পকেটে। এদিকে উপযুক্তমূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যেই ১ কোটি বর্গফুট ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানির অনুমতি পেয়েছে দেশের ৫টি চামড়া শিল্প প্রতিষ্ঠান।  

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পশুর চামড়ার গুণগত মান সংরক্ষণ একটি বড় বিষয়। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে চামড়ায় যত দ্রুত লবণ দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। অর্থাৎ কোরবানির ৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি লবণ দেওয়া যায় সেটাই মঙ্গল। কোরবানির ঈদের আগে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সভায় বলা হয়েছিল যে লবণের কোনও ঘাটতি নাই। তাই আমদানির দরকার নাই। কিন্তু বাজারে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বলছেন, লবণের দাম বেড়ে গেছে। কোরবানির সময় চাহিদা বাড়ে বিধায় এই সুযোগটি হাত ছাড়া করেননি লবণ ব্যবসায়ীরা।

সরকারি মনিটরিংয়ের অভাবে ৬০০ টাকা দামের ৭৫ কেজির বস্তা লবণ বিক্রি হয়েছে ৯০০ টাকা দরে। সময় সুযোগ মতো তা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার থেকে ১২শ টাকায়। ওজনেও দেওয়া হয়েছে কম। ৭৫ কেজির স্থলে বস্তায় দেওয়া হয়েছে ৬০ কেজি। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জন্য বিষয়টি মোটেও সুখবর নয়।

এদিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত বছরের তুলনায় এবছর ৮ লাখের বেশি পশু কোরবানি হয়েছে দেশে। এবছর ৯৯ লাখ ৫০ হাজার পশু কোরিবানি হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার মূল্য ঢাকায় ৪৭- ৫২ টাকা প্রতি স্কয়ার ফুট, ঢাকার বাইরে এর দাম ধার্য হয়েছে ৪০- ৪৪ টাকা। অন্যদিকে খাসীর চামড়া প্রতি স্কয়ার ফুট ১৮-২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে দাম নির্ধারিত হয়। তাই সঠিক তুলনা সম্ভব নয়। তবে এটা ঠিক যে কাঁচা চামড়ার মূল্য অতীতে অনেক বেশি ছিল। যেমন ২০১৩ সালে গরুর চামড়া প্রতি স্কয়ার ফুট ছিল ৮৫-৯৫ টাকা এবং ছাগলের চামড়ার মূল্য ছিল ৫০-৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরে এর দাম ছিল ৭৫-৮০ টাকা। ২০১৭ সালে এটি কমে দাঁড়ায় ৫০-৫৫ টাকা এবং ২০-২২ টাকা আর ঢাকার বাইরে ছিল ৪০-৪৫ টাকা। এ খাতের উদ্যোক্তাদের মতে, আগে চামড়া মানেই লবণযুক্ত চামড়াকেই বোঝানো হতো। ২০১৮-১৯ সময়ে বিষয়টি পরিবর্তন হয়, অর্থাৎ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা লবণ ছাড়াই দ্রুত লবণের দামের সাশ্রয়ের জন্য বড় মহাজনের কাছে কাঁচা চামড়া পৌঁছে দিতে চান কিছু নগদ লাভের জন্য। এখানেই ঘটে বিপত্তি।

এ প্রসঙ্গে বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী ফেরদাউস আরা বেগম জানিয়েছেন, চামড়া শিল্পের খবরে যে ছবিগুলো আমরা দেখতে পাই, তা নিতান্তই করুণ। অপরিচ্ছন্ন, জীর্ণ, খালি পায়ে দিনমজুর অত্যন্ত নোংরা পরিবেশে হাঁটাচলা করছেন লালবাগ-পোস্তা এবং অন্যান্য জায়গায়। তারা যে খুব শিগগিরই অসুস্থ হয়ে পড়বেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করতে চাই অন্তত খালি পায়ে এদের কাজ অনুমোদন না করা, হাতে অন্তত একটি গ্লোভসের ব্যবহার স্বাস্থ্যের কিছুটা হলেও সুরক্ষা দিতে পারে।

জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, চামড়া বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় খাত। এ খাতের উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। গতবছরের তুলনায় কাঁচা চামড়ার দাম বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন দেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে। আমাদের সক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারলে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করা সম্ভব।