তুলনামূলকভাবে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে সবচেয়ে কম সুদ পাওয়া যায়। আবার বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে লাভ কম পাওয়া যায়। অথচ গ্রাহকরা এই দুটি ব্যাংকেই সবচেয়ে বেশি টাকা জমা রাখছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মে মাসের শেষে সোনালী ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে ইসলামী ব্যাংকের আমানত ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সরকারি খাতের কোনও কোনও ব্যাংক ৯ শতাংশ হারে সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করলেও সোনালী ব্যাংকের আমানতের রেট সবচেয়ে কম।
দেখা যাচ্ছে, সোনালী ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে টাকা জমা রাখলে ব্যাংকটি গ্রাহকদের সুদ দেয় মাত্র ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে সুদ পাওয়া যায় ৪ শতাংশ হারে। এছাড়া বিডিবিএল, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংকে টাকা রাখলে সুদ পাওয়া যায় ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ করে। আর জনতা ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে টাকা জমা রাখলে গ্রাহকরা সুদ পান ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এছাড়া ফিক্সড ডিপোজিট ও বিভিন্ন মেয়াদি আমানতের সুদ হার সোনালী ব্যাংকের চেয়ে অন্যান্য ব্যাংকে বেশি।
এদিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমানত সংগ্রহকারী ইসলামী ব্যাংকে মুনাফা আরও কম।
প্রসঙ্গত, সাধারণত ঋণ বিতরণের স্বার্থে সর্বনিম্ন তিন মাস থেকে তিন বছর, বা তারও বেশি সময়ের জন্য ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, তিন বছরের কম মেয়াদি আমানতে ইসলামী ব্যাংক মুনাফা দিচ্ছে ৪ শতাংশেরও কম। যদিও অধিকাংশ ব্যাংক তিন বছরের কম সময়ের জন্য আমানত রাখা গ্রাহকদের ৬ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদি ( তিন বছরের বেশি) আমানতের বিপরীতে ৬ শতাংশের বেশি মুনাফা দেয় ইসলামী ব্যাংক। আর সোনালী ব্যাংক ৬ শতাংশের বেশি সুদ দেয় না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ মাসে দেশের সবগুলো ব্যাংকের (৬১টির) আমানত ছিল ১২ লাখ ৯৮ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এরমধ্যে সোনালী ও ইসলামী— এই দুটি ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ২ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। গত মে মাসের শেষে অগ্রণী ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ বেড়ে ১ লাখ ৯০৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তিন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সিইওরা (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) বলছেন, ব্যাংক তিনটির প্রতি মানুষের আস্থা বেশি। যে কারণে মানুষজন এই তিনটি ব্যাংকে আমানত রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে আমানতের ওপরে ৬ শতাংশ সুদহারের সীমা নির্ধারণ করার পর যেসব ব্যাংক বেশি সুদে আমানতের অফার দিচ্ছে, সেই ব্যাংকগুলোতে মানুষ যেতে চাইছে না। তবে যেসব ব্যাংকে সুশাসনের পাশাপাশি অনিয়ম-দুনীতি কম, সেসব ব্যাংকে বেড়েছে আমানতের প্রবৃদ্ধি। অনেকেই মনে করেন, ইসলামী ব্যাংকে অনিয়ম-দুর্নীতি কম হয়। আর হলমার্কের ঋণ কেলেঙ্কারির পর রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক অনেক সতর্ক হয়েছে। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক তুলনামূলকভাবে সরকারি ব্যাংকের ইমেজ ধরে রেখেছে। এ কারণে এই তিনটি ব্যাংকে আবারও অর্থের পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদের অফার করছে বেসিক ব্যাংক। অথচ এই ব্যাংকটিতে টাকা রাখার প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ নেই। একইভাবে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা (সাবেক ফারমার্স) ব্যাংক। ব্যাংকটি তিন থেকে ছয় মাসের কম সময়ের আমানতে সুদ দিচ্ছে ৭ শতাংশ হারে, ছয় মাস থেকে এক বছরের কম সময়ের জন্য ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং এক বছর থেকে তার বেশি সময়ের জন্য আমানতে সুদ দিচ্ছে সাড়ে ৭ শতাংশ।
অপরদিকে নন-ব্যাংকিং তথা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতে সুদের হার ১০ শতাংশের ওপরে। তবুও এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমানত চলে যাচ্ছে অল্প সুদের ব্যাংকগুলোতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জানায়, টাকার পরিমাণের দিক থেকে সোনালী, অগ্রণী ও ইসলামী ব্যাংকে আমানত বেশি থাকলেও আমানত প্রবৃদ্ধির শীর্ষে রয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, গতবছরের এপ্রিলের আগে বেশি সুদ দিয়েই করপোরেট ও ব্যক্তি শ্রেণির গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করতো ছোট ও দুর্বল ব্যাংকগুলো। কিন্তু নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কম সুদে আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এতেই ছোট ব্যাংকগুলো থেকে আমানত বেরিয়ে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকের রয়েছে একটা বিশেষত্ব, আর সরকারি ব্যাংকের পেছনে সরকার আছে। এই দুটি কারণে এই ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থাও বেশি।’
জানা গেছে, সারা দেশে সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ২২৭টি শাখা রয়েছে, যা ছড়িয়ে আছে গ্রামগঞ্জে। সরকারের ট্রেজারি ব্যাংক হিসেবেও কাজ করে সোনালী ব্যাংক। এই কারণে সোনালী ব্যাংকের আমানত ২০১৬ সালে ১ লাখ কোটি টাকার মাইলফলক ছুঁয়ে যায়। এদিকে ইসলামী ব্যাংকের সারা দেশে শাখা রয়েছে ৫৬১টি। এর বাইরে আরও ২ হাজার ৩০০ এজেন্ট শাখা গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে আছে। ইসলামী ব্যাংকের আমানত ২০২০ সালের জুনে ১ লাখ কোটি টাকার মাইলফলক ছুঁয়েছে। গত মে মাসে ১ লাখ কোটি টাকার আমানত ছাড়িয়ে যায় রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের। অবশ্য ব্যাংকটির আমানতের প্রায় ২৩ শতাংশই সরকারি খাতের। সারা দেশে সেবা দিতে ব্যাংকটির রয়েছে ৯৬০ শাখা ও ২৮০ এজেন্ট আউটলেট। আমানত সংগ্রহে চতুর্থ স্থানে থাকা জনতা ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ৮৯ হাজার কোটি টাকা।