পেঁয়াজের বাজারে কীসের আলামত?

নিত্যপণ্যের বাজারে চলছে টানা অস্থিরতা। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দামও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অথচ এ সময়ে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই। তারপরও বেড়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধি কোথায় গিয়ে থামবে জানে না কেউই। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নিয়ে সন্দিহান ক্রেতারাও। বাজার ঘুরে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সপ্তাহেও বাজারে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। বর্তমানে সেই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তা বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা দরে।

বিক্রেতারা জানিয়েছেন, শীতের শেষভাগে ভারী বৃষ্টি হওয়ায় পেঁয়াজের আশানুরূপ ফলন হয়নি। এ কারণে বাজারে পেঁয়াজের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হয়েছে। এ ছাড়া সামনে রোজার মাস, মানুষের মধ্যে বেশি করে পেঁয়াজ কেনার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ব্যবসায়ী হিসেবে আমরা হতাশ। কারণ, জিনিসের দাম বাড়লে বা বাজারে অস্থিরতা হলে বেচাকেনা ভালো হয় না।

আরেক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাজারে এখন দেশি যে পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে তা মুড়ি কাটা পেঁয়াজ। এই পেঁয়াজের সরবরাহ এখন প্রায় শেষের পথে। ফলে পেঁয়াজের সরবরাহ কিছুটা কম। তবে ফরিদপুর, মেহেরপুরের বড় সাইজের পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করেছে। ১০-১২ দিনের মধ্যে হালি পেঁয়াজও বাজারে আসবে। তখন পেঁয়াজের দাম কমে যাবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

ক্রেতারা জানিয়েছেন, রোজার সময় দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু রোজা আসতে এখনও এক মাসের মতো বাকি। তারপরও কেন পেঁয়াজের দাম বাড়ছে তা বোধগম্য নয়। সব পণ্যের দাম যখন বাড়ছে, সেই সুযোগে ব্যবসায়ীরাও পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে একশ্রেণির ক্রেতা রয়েছেন, নানা গুজবে কান দিয়ে রোজার জন্য এখনই পেঁয়াজ কিনে রাখছেন। তারা বুঝতে চাচ্ছেন না, এখন যে পেঁয়াজ বাজারে এসেছে তা কাঁচা। বেশি দিন রাখা যাবে না, পচে যাবে।

ফরিদপুরের পেঁয়াজ চাষি মোস্তফা হাওলাদার জানিয়েছেন, বাজারে যখন মুড়ি কাটা পেঁয়াজ ভরপুর ছিল, তখন দাম বেশ কম ছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে এসে মুড়ি কাটা পেঁয়াজের সরবরাহ কমে গেছে। এ সময়ে পেঁয়াজের দাম সব বছরই কিছুটা বাড়ে। এবারও তাই। এ কারণেই ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের পরে এসে এক দফা পেঁয়াজের দাম বেড়ে ৬০ টাকা কেজি হয়। অবশ্য তখন এক সপ্তাহের মধ্যেই পেঁয়াজের দাম আবার কমে ৪৫ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু এ বছর তা হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন এবং আমদানি দুটোই বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস’র ২০১৭ ও ২০১৯ সালের তথ্যে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত পেঁয়াজের উৎপাদন ১৭-১৮ লাখ টনে মোটামুটি স্থিতিশীল থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা বেড়েছে। একই সঙ্গে সেই সময়ে উৎপাদনের বিপরীতে ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে গত পাঁচ বছরে আমদানির পরিমাণও প্রায় আড়াইগুণ বেড়েছে। তবে গত ২-৩ বছরে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে অবিশ্বাস্য পরিমাণে। 

অপরদিকে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যচিত্রে বাংলাদেশে গত এক দশকে পেঁয়াজের আবাদি জমি, উৎপাদন ও ফলন (২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত) সবই প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাম্প্রতিক তথ্যমতে, ২০২১ সালে ২ দশমিক ৩৭ লাখ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে ৩২ লাখ মেট্রিক টন। যা উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশকে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে উন্নীত করেছে। কিন্তু এত উৎপাদনের পরও দেশে পেঁয়াজের সংকট এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি কৃষিবিদ, বিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের জন্য যা সত্যিই দুশ্চিন্তার কারণ।  

এভাবে উৎপাদন বাড়ার পরও পেঁয়াজ সংকটের মূলে রয়েছে আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ব্যাপক বৃদ্ধি। গত এক দশকে দ্বিগুণের বেশি উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি আমদানিও বেড়েছে প্রায় আটগুণ। এরপরও সরবরাহে সংকটের বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও একটি মহল থেকে বলে বেড়ানো হচ্ছে, উৎপাদনের পাশাপাশি দেশে পেঁয়াজের চাহিদাও বেড়েছে ব্যাপক।

কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ ২০২০-এর তথ্যমতে, ২০২০ সালে পেঁয়াজের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ছিল ১৯ দশমিক ৫৪ লাখ টন। যেহেতু পেঁয়াজ একটি পচনশীল পণ্য তাই মোট উৎপাদনের শতকরা ১৭ থেকে ২৫ শতাংশ সংগ্রহোত্তর অপচয় হিসেবে ধরলে ব্যবহারের উপযোগী পেঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ৬৫৫ লাখ টন। অন্যদিকে, মাথাপিছু পেঁয়াজের বর্তমান ব্যবহার ৩২ গ্রাম। এই হিসাবে নিট ভোগ্যপণ্য হিসেবে মোট চাহিদা দাঁড়ায় ১৯ দশমিক ৮৬ লাখ টন। তাছাড়া বীজ উৎপাদন, মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত ও ওষুধ শিল্পে ব্যবহার মিলিয়ে দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক মোট চাহিদা প্রায় ২২ লাখ টন।

জানা গেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে পেঁয়াজ আমদানি করা হয় ৬ দশমিক ৪১ লাখ টন। ২০২১ সালে আমদানি করা হয়েছে ৭ লাখ ৬২ হাজার মেট্রিক টন।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, দেশে কোনও ভোগ্যপণ্যেরই সংকট নাই। রমজান উপলক্ষে যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে সেসব পণ্যের যথেষ্ট মজুত রয়েছে। কাজেই সংকট সৃষ্টির গুজবে কান না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিনে মজুত করে না রাখার জন্য ক্রেতাদের প্রতি অনুরোধ করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী।