এবার দেশে পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে লবণের দাম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবতো আছেই। পাশাপাশি চামড়া প্রক্রিয়াজাতে ব্যবহৃত রাসায়নিকের দামও বেড়েছে। শুধু তাই নয়, আগের মতো মৌসুমি ব্যবসায়ীদের হাতে টাকাও নেই। আবার পাওনা টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে এখনও পর্যন্ত খুব একটা ইতিবাচক সাড়া পাননি পোস্তার ব্যবসায়ীরা। এমনকি ব্যাংকগুলো এবার ট্যানারি মালিকদের ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। এসব সত্ত্বেও এবার কাঁচা চামড়ার কদর বেশি। বিশেষ করে চামড়া রফতানিকারক ব্যবসায়ীদের কাছে চামড়ার চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। তথ্য বলছে, গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার গড় মূল্য বেড়েছে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। একই সময়ে বেড়েছে রফতানির চাহিদাও। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর (২০২১-২২) বাংলাদেশ চামড়া খাতে রফতানি থেকে আয় করেছে ১২৫ কোটি মার্কিন ডলার। যদিও এ সময় রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ১০৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি চামড়া রফতানি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, চামড়া রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে আগের বছরের তুলনায় ৩২ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বিপরীতে রফতানি আয় ধরা হয়েছিল ১১২ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ১০২ কোটি ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল ১ হাজার ৮৫ কোটি ডলার। ওই বছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রফতানি আয় কমেছে ৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে ৬ শতাংশ।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রফতানি আয় হয় তৈরি পোশাক খাত থেকে। মোট রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। যদিও এর বড় অংশই চলে যাচ্ছে ব্যাক টু ব্যাক এলসির আড়ালে আমদানি বাবদ। ফলে প্রকৃত রফতানির পরিমাণ খুব কম। এদিকে চামড়া খাত থেকে দ্বিতীয় সবচেয়ে বেশি রফতানি আয় হয়। এ খাতে ব্যাক টু ব্যাক এলসির পরিমাণ খুবই কম।
বাংলাদেশের চামড়ার ব্যাগ জাতীয় পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার চীন। বেলজিয়াম, হংকং, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্পেন ও ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে বেশ ভালো পরিমাণে রফতানি হয় ব্যাগ-জাতীয় পণ্য। আর চামড়ার জুতার বড় বাজার জার্মানি। এ ছাড়া কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণে রফতানি হয় বাংলাদেশে তৈরি চামড়ার জুতা। এমনকি জাপানেও বাংলাদেশি চামড়ার ব্যাগ ও জুতার চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পাকা চামড়া ও জুতার পাশাপাশি এখন ট্রাভেল ব্যাগ, বেল্ট, ওয়ালেট বা মানিব্যাগ বিদেশে রফতানি হচ্ছে। এছাড়া ওইসব দেশে চামড়ার তৈরি নানা ‘ফ্যান্সি’ পণ্যেরও চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রচুর হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো এসব পণ্য তৈরি করে বিশ্বের বাজারে পাঠাচ্ছে।
শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, চামড়া খাত অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। ঠিকমতো পরিচর্যা ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মান নিশ্চিত করতে পারলে, এ খাত থেকে ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন রফতানি আয় সম্ভব। কিন্তু এ খাতে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে— কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ইউরোপিয়ান, ইটালিয়ান ও ভারতীয় কোম্পানি আসছে। কিন্তু কারও কাছ থেকে সমাধানের ভালো প্রকল্প পাওয়া যাচ্ছে না। জাকিয়া সুলতানা মনে করেন, চামড়ার সঠিক দাম নিশ্চিত করাও চ্যালেঞ্জ। কোরবানির সময় চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা সে দাম পান না।
এদিকে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারও ইতোমধ্যে চামড়ার দাম বাড়িয়েছে। এবার লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দর প্রতি বর্গফুটে ৭ টাকা, আর খাসির চামড়ার দাম ৩ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার গড় মূল্য পতন ঘটে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে দাম কমে ৮ দশমিক ৩ এবং ২০২০ সালে কমে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২১ সালে অবিশ্বাস্যভাবে এর মূল্য বৃদ্ধি পায়। ওই বছর গড় মূল্য বেড়েছে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। এই মূল্যবৃদ্ধি ২০২২ সালেও অব্যাহত আছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০২৮ সাল পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে এর চাহিদা বাড়বে।
চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক বছরে চামড়ার মূল্য বাড়লেও দেশের বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম এত দিন বাড়েনি। তবে এবার সরকার নির্ধারিত দরে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ঢাকায় কেনা হবে ৪৭-৫২ টাকা, গ্রামে ৪০-৪৪ টাকা। এছাড়া খাসির চামড়া প্রতি বর্গ ফুট ১৮-২০ টাকা এবং বকরির ১২-১৪ টাকা মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিকল্পিতভাবে চামড়ার দাম ফেলে দেওয়ার জন্য প্রতিবছরই কোরবানির চামড়া ঘিরে একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়। যেখানে ট্যানারি মালিকদের পাশাপাশি অনেক আড়ত মালিকও জড়িত থাকেন। যে কারণে চামড়া কেনাবেচার মূল্য সরকার ঘোষণা করলেও শেষ পর্যন্ত মূল্যে বড় ধরনের ধস নামে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ‘আশা করছি, বিগত বছরগুলোর মতো এবার চামড়া নষ্ট হবে না। কারণ, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লবণসহ চামড়া আড়তে বা ট্যানারিতে দিয়ে আসবে। আর ঈদের সাত দিন যদি বাইরের চামড়া ঢাকায় না আসে, তাহলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লোকসানের শিকার হবেন না।’
তিনি উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা বাড়লেও বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির কারণে ইউরোপের মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো নেই। চামড়া একটি শৌখিন পণ্য। ফলে ইউরোপে এর চাহিদা কমছে। এছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে চামড়া খাতে ব্যবহৃত সব ধরনের কেমিক্যালের মূল্য ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া বেড়েছে লবণের দামও। এর বাইরে জ্বালানির দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে কনটেইনার খরচ কয়েক গুণ বেড়েছে। ফলে আমরা এসব বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন।
অবশ্য সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, এবার কোরবানির চামড়ার বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি প্রতিরোধে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও সমস্যা সমাধানে যৌথ সমন্বয়সহ ১১টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঈদের দিন থেকেই শুরু হবে এসব কমিটির কার্যক্রম। এর মধ্যে বাণিজ্য সচিবকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে ১৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় যৌথ সমন্বয় কমিটি। এছাড়া জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামানকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে ৭ সদস্যের সমন্বয় ও মনিটরিং কমিটি। এই কমিটি অন্যান্য কার্যক্রমের সঙ্গে বাজারে লবণ সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং অন্য মনিটরিং টিমগুলোকে তত্ত্বাবধান করবে। ঈদের দিন থেকে পরবর্তী ৫ দিন এসব কমিটি প্রয়োজনীয় মনিটরিং করবে। বিশেষ করে নির্ধারিত মূল্যে কেনা ও বেচা মনিটরিং করা হবে।
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগেও ৫ সদস্য বিশিষ্ট মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। সিলেট বিভাগের জন্য চার সদস্যের, রাজশাহী অঞ্চলের জন্য চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। খুলনা, ময়মনসিংহ, রংপুর ও বরিশাল বিভাগের কমিটিগুলো কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও মজুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, চামড়া ক্রয় ও বিক্রয় কার্যক্রম মনিটরিং করবেন।
জানা গেছে, টানা চার বছর কোরবানির পশুর চামড়া কিনে বিপাকে পড়েন মৌসুমি কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা। গত কয়েক বছর ধরে কোরবানির পশুর চামড়ার একটি অংশ পচে যেতে দেখা গেছে। এ কারণে চামড়া কেনায় অনীহা দেখা দেয় তাদের। দেশের চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী ট্যানারি মালিকরা গত কয়েক বছর চামড়া কেনার জন্য বাজারে পর্যাপ্ত টাকা ছাড়েননি। যদিও এ জন্য তারা ব্যাংক-ঋণ না পাওয়াকে দায়ী করেছিলেন। চাহিদা কম থাকায় দামও তলানিতে নেমে যায়। অনেকে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেন। অনেক জায়গায় বাড়তি দামে লবণ কিনে সংরক্ষণ না করায় পচে যায়।
বিশেষ করে ২০১৮ সালে হুট করে দাম পড়ে যায় কাঁচা চামড়ার। ২০১৯ সালে হয় ভয়াবহ দরপতন। ২০২০ সালে করোনার কারণে অব্যাহত থাকে সেই ধারা। ২০২১ সালেও ব্যবসা না থাকায় ট্যানারি মালিকরাও চামড়া নিতে আগ্রহ দেখাননি। এই কয়েক বছর লাখ লাখ টাকার চামড়া রাস্তায় ফেলে দিতে বাধ্য হন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে যে কাঁচা চামড়ার দাম ছিল ১৭০০ টাকা, ২০১৮ সালে তা হয় ১২০০ টাকা এবং ২০১৯ সালে বিক্রি হয় ৪০০ টাকায়। ২০২০ ও ২০২১ সালে একই মাপের চামড়ার দাম ঠেকে গিয়ে ৩০০-৪০০ টাকায়। গত দুই বছর মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আড়তে নিয়ে গরুর চামড়া গড়ে ১০০ টাকা ও ছাগলের চামড়া ১০ টাকায়ও বিক্রি করেছেন। অনেকে দাম শুনে রাগ করে সড়কের ওপর চামড়া ফেলে গিয়েছিলেন। পরে বাধ্য হয়ে সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।