চামড়া কিনে এবারও কি ঠকবেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা?

কোরবানির পশুর চামড়ার দাম ঠিক করেছে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়া সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে কিনবেন ট্যানারি মালিকরা। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কত টাকায় চামড়া কিনবেন, এ নিয়ে প্রতিবারই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আবার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে কাঁচা চামড়া কিনেও লোকসান গুনছেন, এমন আলোচনা প্রায়ই শোনা যায়।

এদিকে কোরবানি দিয়ে চামড়া বিক্রি করার কথা ভুলে যেতে বসেছে অনেকেই। কারণ, বাংলাদেশে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম গত কয়েক বছর ধরেই তলানিতে নেমে এসেছে। চামড়া খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে চাহিদার তুলনায় বিপুল পরিমাণ চামড়ার সরবরাহই এর মূল কারণ। আর চাহিদা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তারা রফতানি পড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।

সরকার অবশ্য গত বছরের তুলনায় এবার লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ৬ শতাংশ বাড়িয়ে নির্ধারণ করে দিয়েছে। চামড়ার দাম ধরে রাখতে ঈদের পরবর্তী ৭ দিন ঢাকার বাইরে থেকে চামড়া না আনার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এবার সরকার ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৫০-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪৫-৪৮ টাকা নির্ধারণ করেছে। গত বছর এই দাম ছিল ঢাকায় ৪৭-৫২ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০-৪৪ টাকা। গত বছর ছাগলের চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৮-২০ টাকা, যা এ বছরও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।

যারা কোরবানি দিচ্ছেন এবং মৌসুমি চামড়ার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তারা বলছেন—বছর দশেক আগেও প্রতিটি গরুর চামড়ার দাম গড়ে ১৫০০ টাকা থাকলেও গত দুই-তিন বছর ধরে এটি গড়ে ৫০০ টাকায় নেমে এসেছে।

রাজধানীর গোপীবাগ এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহমান মনসুর বলেন, ‘১০ বছর আগে একটা গরুর চামড়া ৩ হাজার থেকে শুরু করে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যেতো। এমনকি বিভিন্ন জেলায় গ্রামগঞ্জেও একটা গরুর চামড়া ৩-৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতেন কোরবানিদাতারা। সেই সময় একটি গরুর চামড়া বিক্রি করে পুরো টাকাটা একজন গরিবকে দিলে ওই মানুষটির কয়েক মাস চলে যেতো।

কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে কাঁচা চামড়ার দাম এতটাই কমেছে যে একটি গরুর চামড়া বিক্রির টাকা দিয়ে গরিব মানুষের এক সপ্তাহ চলার সুযোগ নেই। ব্যবসায়ীরা চামড়া কেনার জন্য খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। মাদ্রাসার লোকদের ডেকে ডেকে চামড়া দিয়ে দিতে হচ্ছে।

বিশেষ করে কোরবানির সময় চামড়া কিনে ‘মৌসুমি ব্যবসায়ী’ হিসেবে যারা পরিচিত ছিলেন, তারাও আর এই ব্যবসা করছেন না। এর কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন, ২০১৭ সালের পর থেকে চামড়ার দাম এতটাই কমে গেছে যে লাভের মুখ দেখা হয় না।

তবে লাভ করতে হলে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বুঝে-শুনে চামড়া কেনার পরামর্শ দিয়েছেন পুরান ঢাকার পোস্তার কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিনস মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. টিপু সুলতান।

তিনি বলেন, ‘লবণযুক্ত চামড়া সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে কেনা ঠিক হবে না। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বলবো, তারা যেন অবশ্যই এর চেয়ে কম রেটে কাঁচা চামড়া কেনেন। কারণ, মাঝারি আকারের একটি গরুর চামড়া সংরক্ষণে ৮ থেকে ৯ কেজি লবণ লাগে। এর সঙ্গে শ্রমিকদের মজুরি ও গোডাউন ভাড়া আছে।’

টিপু সুলতান বলেন, ‘মাঝারি বা ছোট সাইজের গরুর চামড়া সাধারণত ২০ থেকে ২২ বর্গফুট হয়। এই আকারের লবণ ছাড়া কাঁচা চামড়া ৫০০ টাকায় কিনতে হবে। মাঝারি সাইজের গরুর চামড়ার দাম হবে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। আর  দুই লাখ বা তার ওপরের দামের গরুর বড় আকারের চামড়ার দাম ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা।’

সাধারণত, কোরবানির চামড়া বাসাবাড়ি থেকে কিনে নেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তারা সেই চামড়া বিক্রি করেন পাইকারদের কাছে। আর পাইকাররা লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করে তা বিক্রি করেন ট্যানারিতে।

ট্যানারি কেমন দামে চামড়া কিনবে তা প্রতিবছর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তার মানে এখানে কয়েক হাত ঘুরে যে দাম হবে, সেটিই নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ যারা কোরবানি দেন তাদের চামড়া বিক্রি করতে হয় সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় অনেক কমে।

ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘প্রতি পিস কাঁচা চামড়া গড়ে আমরা ৬০০ থেকে এক হাজার টাকায় কিনবো। সেই হিসাবে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এটাকে সমন্বয় করে চামড়া কিনবেন।’

এদিকে চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার পেছনে রফতানি কমে যাওয়াকে বড় কারণ বলে মনে করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে চামড়া রফতানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। এ কারণে দেশীয় ট্যানারির মালিকদের কাছে চামড়ার চাহিদা কমে গেছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ১৬ সালের আগে যেসব বায়ার ছিল, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বায়ার বা ফার-ইস্টের সাউথ কোরিয়া, জাপান বিশেষ করে যারা কমপ্লায়ান্ট বায়ার, তারা বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন নন-কমপ্লায়ান্ট বায়ারদের কাছে অর্ধেকেরও কম দামে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে চামড়ার দাম কমেছে।

এর আগে গত ২৫ জুন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ট্যানারি মালিক, ট্যারিফ কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে ঢাকায় ৩ টাকা, ঢাকা বাইরে ৫ টাকা বাড়িয়ে গরুর কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার।

বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় গত বছরের চেয়ে ৩ টাকা, ঢাকার বাইরে ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আর খাসি ও বকরির চামড়ার দাম গতবারের মতো রাখা হয়েছে।

গত বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ছিল ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা। ঢাকায় খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ১৫ থেকে ১৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ছিল ১২ থেকে ১৪ টাকা বর্গফুট।

বাংলাদেশে প্রতি বছর যত পশু জবাই হয়, তার অর্ধেকেরও বেশি চামড়া সংগ্রহ হয় কোরবানির সময়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, সবশেষ ২০২২ সালেও ৯৯ লাখ ৫০ হাজারের বেশি পশু কোরবানি করা হয়েছিল।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য বলছে, কোরবানি দেওয়া যায়—এ বছর এমন গবাদিপশুর মোট সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ১১ হাজার ৯৪৪টি বেশি। অপরদিকে এ বছর কোরবানির পশুর সম্ভাব্য চাহিদা ১ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি। সেই হিসাবে এ বছর কোরবানি শেষ হওয়ার পরও দেশে ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৯৪টি কোরবানিযোগ্য পশু উদ্বৃত্ত থেকে যেতে পারে।