প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্যেও বৈদেশিক মুদ্রা আনার ক্ষেত্রে আশা জাগাচ্ছে কেবল তৈরি পোশাক খাত। চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) সেপ্টেম্বরে একক মাস হিসাবে পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪.৪৬ শতাংশ। এ সময় রফতানি হয়েছে ৩৬১ কোটি ডলার। আগের বছর একই সময়ে রফতানি ছিল ৩১৬ কোটি ডলার।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের তৈরি পোশাক খাতের বড় বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় রফতানি কমলেও পোশাক খাত তার উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে।
যদিও পোশাক রফতানিকারকরা বলছেন, ক্রয়াদেশ পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নাজুক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। অবশ্য খাত সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্যকরণ, প্রযুক্তি আপগ্রেডেশন, উদ্ভাবনসহ প্রবৃদ্ধির নতুন সুযোগগুলো অন্বেষণ করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের সুফল হিসেবেই পোশাক রফতানি বাড়ছে। তবে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে পোশাক রফতানি কমে যাওয়া দেশের ও পোশাকশিল্পের জন্য উদ্বেগের বলেও মত দিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় এই উৎস থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৫০০ কোটি ডলার পাওয়া যায়। প্রবণতা বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগের মাসের চেয়ে সেপ্টেম্বরে রফতানি কম হয়েছে ৪৭ কোটি ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে পণ্য রফতানি থেকে এসেছে ৪৩১ কোটি ডলার। আগস্টে এর পরিমাণ ছিল ৪৭৮ কোটি ডলার। রফতানি খাতের সবচেয়ে বড় পণ্য তৈরি পোশাক। সমজাতীয় পণ্যসহ মোট রফতানি আয়ের ৮৬ শতাংশের মতো আসে এ খাত থেকে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের পোশাক রফতানি আয় এক হাজার ১৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। এই সময়ের মধ্যে সামগ্রিক পোশাক রফতানি ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩.০৭ শতাংশ বেশি।
নিটওয়্যার খাত থেকে রফতানি হয়েছিল ৬৭৬ কোটি ডলার, যেখানে ওভেন পোশাক থেকে রফতানি আয় ৪৮৫ কোটি ডলার। নিট এবং ওভেন উভয় খাত থেকে রফতানি যথাক্রমে ১৯.৭০ শতাংশ ও ৪.৯৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার বাজারে আমাদের উদ্বেগ বাড়লেও নতুন বাজারে পোশাক রফতানি বাড়ছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, নতুন বাজারে রফতানি বাড়ার কারণ হচ্ছে—পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্যকরণ, প্রযুক্তির উন্নয়ন, উদ্ভাবনসহ প্রবৃদ্ধির নতুন সুযোগগুলো অন্বেষণ করা।
ইপিবির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের শুধু সেপ্টেম্বর মাসে পোশাক রফতানির মধ্যে ওভেন পোশাকে আয় হয়েছে ১৪৪ কোটি ডলার, প্রবৃদ্ধি ০.৭৪ শতাংশ। নিট পোশাকে আয় ২১৮ কোটি ডলার, প্রবৃদ্ধি ২৫.৭৬ শতাংশ। এই তিন মাসে পোশাক রফতানিতে মোট আয় হয়েছে ৩৬২ কোটি ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪.৪৬ শতাংশ।
এদিকে পোশাক রফতানিতে ইতিবাচক প্রভাব থাকলেও কাঁচামাল ব্যবহারের অনুমোদিত নথি ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশনের (ইউডি) তথ্যে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে।
পোশাক পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে কারখানাগুলোকে দেওয়া ইউডির অর্থমূল্য ছিল ৬৯৪ কোটি ৪৯ লাখ ৪৪ হাজার ডলার (২৯৯ দশমিক ৫২ শতাংশ)। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে হয়েছে ৬২২ কোটি ৯৩ লাখ ৩৫ হাজার ডলার (৮৬৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ)। অর্থাৎ গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ইউডির অর্থমূল্য হ্রাস পেয়েছে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ।
সদ্য বিদায়ী সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্সে বড় পতন হয়েছে। এ মাসে মাত্র ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। গত ৪১ মাসের মধ্যে আর কোনও মাসে এত কম রেমিট্যান্স আসেনি। গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৯ কোটি ৫৯ লাখ ডলার কম। অর্থাৎ রেমিট্যান্স কমেছে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ। আগের মাস আগস্টের চেয়ে কমেছে ১৬ শতাংশ। আগস্টে এর পরিমাণ ছিল ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলার।
বিদেশি ঋণের ছাড়, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে নেই কোনও সুখবর। ডলারের সব উৎসে চলছে ভাটার টান। অপরদিকে বিদেশি ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। এ ঋণে সুদের হারও এখন বেশি। একে তো ডলার আসছে কম, আবার পরিশোধ করতে হচ্ছে বেশি। এ দ্বিমুখী পরিস্থিতি রিজার্ভ সংকটের চাপকে আরও অসহনীয় করে তুলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ১০ বিলিয়ন ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম একটি উৎস বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ বা এফডিআই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে এফডিআই কমেছে ২৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। মোট ৬২ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের এফডিআই এসেছে এ সময়ে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডির হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলে পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০ কোটি ডলার, যা আগের একই সময়ের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল মাত্র ২৮ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধের পরিমাণ ৪ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা।
এছাড়া গত দুই মাসে মূল ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ২৯ শতাংশ। এ সময় মূল ঋণ পরিশোধ করা হয় ২৫ কোটি ৪১ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১৯ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। আর শুধু সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫৮ শতাংশ। ১৪ কোটি ৬৩ লাখ ডলার সুদ পরিশোধ করা হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯ কোটি ২৮ লাখ ডলার। অন্যদিকে, ঋণ এবং অনুদান মিলে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের পরিমাণ অর্থাৎ অর্থছাড় কমেছে ১১ শতাংশ। ৭৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার পাওয়া গেছে গত দুই মাসে। গত অর্থবছরের এ দুই মাসে যার পরিমাণ ছিল ৮৬ কোটি ৪২ লাখ ডলার। অর্থাৎ, একদিকে ঋণের সুদ এবং আসল পরিশোধের চাপ বেড়েছে, অন্যদিকে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড় কমেছে। ইআরডির প্রাক্কলন অনুযায়ী, এ অর্থবছরে ৩২৮ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হবে। যদিও গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৭৪ কোটি ডলার।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রবাসী ও রফতানি আয় দিয়ে। অথচ এই দুটি খাতেই গতি কম।’
তিনি বলেন, ‘একদিকে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কমছে, অপরদিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধের দায় ক্রমেই বাড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হার বেড়েছে, অথচ রেয়াতকাল পরিশোধের সময়সীমা কমেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বাড়ছে।’
এদিকে অনেক শিল্পকারখানা ডলার-সংকটে কাঁচামাল আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এখনও পর্যন্ত আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে ১৮ শতাংশ। এছাড়া ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ২২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ১ হাজার ৫২ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ১ হাজার ২৮৫ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছিল। গত দুই মাসে ১ হাজার ১৭৭ কোটি ডলারের ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ১ হাজার ৫১৪ কোটি ডলারের ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছিল।
ব্যাংক থেকে ডলার না পেয়ে অনেকেই এখন রফতানিকারকদের কাছ থেকে ডলার সংগ্রহে নেমেছেন। তাতে রফতানির চেয়ে অর্জিত ডলারের দামও অনানুষ্ঠানিকভাবে বেড়ে গেছে। ঋণপত্র খুলতে নির্ধারিত দামের চেয়ে ডলারপ্রতি পাঁচ-ছয় টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। এতে একদিকে উৎপাদনে ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে কাঁচামালের সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।