আগস্টের শেষ দিকে বিভিন্ন ওষুধ কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হয়। শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু হলে একে একে বন্ধ হয়ে যায় ১৭টিরও বেশি ওষুধ কারখানা। গাজীপুর, টঙ্গী ও আশুলিয়া এলাকায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের পাশাপাশি আন্দোলন শুরু করে ওষুধ শিল্পের শ্রমিকরা। এতে উৎপাদন ব্যাহত হয়। পাশাপাশি বেশ কিছু কারখানায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। সরকারের কাছে ওষুধ শিল্পের মালিকরা নিরাপত্তা চাইলে বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) থেকে শিল্প এলাকায় কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে ধীরে ধীরে কারখানার কার্যক্রম স্বাভাবিক হওয়া শুরু হয়েছে।
দেশের শিল্পাঞ্চল এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে গত ২৭ আগস্ট ওষুধ শিল্প মালিক সমিতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর চিঠি দেয়। চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে অস্থায়ী কর্মচারীরা বিভিন্ন অযৌক্তিক দাবিতে, আইনবহির্ভূত আন্দোলন করছেন। তারা অনেক ফ্যাক্টরিতে কর্মকর্তাদের প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছেন। এসব কারণে কোম্পানির স্থায়ী কর্মচারীরা কাজে যোগদান করতে পারছেন না। এরইমধ্যে পর্যায়ক্রমে ১২টি কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আশঙ্কা করছি—এভাবে সব কোম্পানিতে হামলা চলতে থাকলে ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো তাদের স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে না।
চিঠিতে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, স্বনির্ভর এবং ক্রমবর্ধমান ওষুধ শিল্পের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য এবং এই শিল্পকে ধ্বংস করার সুদূরপ্রসারী চক্রান্তে একটি অশুভ শক্তি সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। উল্লেখ্য, ওষুধ শিল্পে গত তিন দশকে উল্লেখযোগ্য কোনও শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়নি, সেখানে ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ দেশের বিরুদ্ধে বড় কোনও ষড়যন্ত্রের অংশ। অনতিবিলম্বে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করা না গেলে দেশের ওষুধ শিল্প চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদের পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।
এরপর গত ৩১ আগস্ট আরেকটি চিঠিতে ওষুধ শিল্প সমিতির মালিকরা চারটি সুপারিশের কথা জানান। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে—
গত ১ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের কালিয়াকৈরে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সামনে বিক্ষোভের সময় বৈষম্য নিরসনসহ ২১ দফা দাবি জানিয়ে ছিলেন আন্দোলনরত শ্রমিকরা। শ্রমিকদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে—অফিস চলাকালীন এবং অফিসে যাতায়াতের সময় যদি কোনও কর্মী দুর্ঘটনার শিকার হন, তাহলে তার সম্পূর্ণ চিকিৎসার খরচ কোম্পানি বহন করবে। একইসঙ্গে ওই কর্মীকে এককালীন আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কারখানার এজিএম সুরজিৎ মুখার্জি এবং প্রডাকশন সিনিয়র মানবসম্পদ বিভাগের ম্যানেজার দিপালক কর্মকার, সিনিয়র ম্যানেজার জাহিদুর রহমান, মানবসম্পদ কর্মকর্তা সাম্মি আক্তার ও রুহুল আমিনকে পদত্যাগ করতে হবে। ছুটির জন্য হয়রানিমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে। নন-ম্যানেজমেন্ট কর্মীদের সঙ্গে সর্বদা সহনশীল সদাচরণ করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের কোনও কর্মীকে পরবর্তী সময়ে হয়রানি বা চাকরিচ্যুত করা যাবে না। কোনও ধরনের বৈষম্যমূলক এবং অপমানজনক আচরণ করা যাবে না। এছাড়া কর্মীদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীদের উত্তম আচরণ করতে হবে। প্রতি দুই বছর পর পর স্থায়ী কর্মীদের গ্রেড উন্নয়ন করতে হবে। নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করতে হবে। সঙ্গে ছুটিকালীন সম্পূর্ণ বেতন এবং ভাতা দিতে হবে।
তবে একেক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের দাবি একেক রকম ছিল। মূলত ভালো বেতন, চাকরি নিয়মিতকরণের দাবি ছিল আন্দোলনকারীদের মূল চাওয়া।
ওষুধ কারখানার মালিকরা বলছেন, এই শিল্পে এর আগে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি। এর পেছনে ষড়যন্ত্র খতিয়ে দেখা দরকার। আন্দোলনের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে অনেকেই কারখানা চালু করেননি।
শ্রমিকরা বলছেন, দাবি নিয়ে কোনও ধরনের আশ্বাস না দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় দুই সপ্তাহের এ আন্দোলনে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, নুভিস্তা ফার্মা লিমিটেড, ওরিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, রেনেটা লিমিটেড, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসি, জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, অপসোনিন ফার্মা লিমিটেড, দ্য একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড, এরিস্টোফার্মা লিমিটেড, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল পিএলসি, ডিবিএল ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড, এসএমসি ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড, জিসকা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড, সিটুসি ফার্মা লিমিটেড এবং ইনসেপ্টার দুটি কারখানাসহ ১৯টি ওষুধ কারখানায় উৎপাদন বন্ধ ছিল।
গত ৩ সেপ্টেম্বর ওষুধ শিল্প মালিক সমিতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, আরও কয়েকটি বন্ধ হওয়ার পথে। এতে দেশে ওষুধের সংকট দেখা দিতে পারে। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সমিতির সভাপতি আবদুল মুক্তাদির সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘স্টাফদের বন্দি করে রেখে তারা (শ্রমিকরা) কাগজে সই নিতে চাচ্ছে। সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) সকাল পর্যন্ত একটি কোম্পানির স্টাফদের বন্দি করে রাখা হয়। ইনসেপ্টায় প্রায় ৪০০ স্টাফকে সকাল ৮টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত আটকে রাখা হয়। শ্রমিকরা দাবি জানাতে পারে, তাই বলে এভাবে জিম্মি করা তো ঠিক না। বিজ্ঞানী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হেনস্তা করা হচ্ছে। এভাবে জিম্মি করে রাখবে এবং আমরা সহযোগিতা পাবো না— এটা আমাদের জন্য উদ্বেগের ও হতাশাজনক। আমরা ভাবতে পারছি না যে কর্মীরা এমন আন্দোলন করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘এভাবে চললে মজুত থাকা ওষুধ দিয়ে কিছু দিন হয়তো চলবে, কিন্তু এরপর সংকট তৈরি হবে। এর পেছনে কারা আছে, আমরা সেটি জানি না। কিন্তু ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এটা বুঝতে পারছি। তাই সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’
এরিস্টোফার্মা লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের দুটি ফ্যাক্টরির একটি টঙ্গী এলাকায়। সেখানে একটু ঝামেলা হয়েছিল, তবে এখন স্বাভাবিক আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ওষুধ কারখানার একজন স্বত্বাধিকারী জানিয়েছেন, শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী বেতন বৃদ্ধি করা হলে এর প্রভাব সরাসরি ক্রেতার ওপর এসে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে ওষুধের দাম বাড়ানো ছাড়া বিকল্প থাকবে না।
পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালসের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তাদের কোম্পানি ৩০০ অনিয়মিত কর্মীর সবাইকে নিয়মিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) থেকে গাজীপুরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে খুলে দেওয়া হয়েছে তৈরি পোশাক কারখানাসহ সব শিল্প প্রতিষ্ঠান। শিল্প পুলিশের শিল্পাঞ্চল-২-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান আহম্মেদ বলেন, ‘সব কারখানাই খোলা রয়েছে। কারখানা এলাকার নিরাপত্তায় শিল্প পুলিশের প্রায় ৯০০ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া বিজিবি ও সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে।’
ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি আব্দুল মুক্তাদির বৃহস্পতিবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে কারখানাগুলো।’