এলপিজির মূল্য নির্ধারণ: তোয়াক্কা করছেন না ব্যবসায়ীরা, আগের দামেই বিক্রি

দেশে প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে এলপিজির মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয় গত ১২ এপ্রিল। ওই দিন থেকেই নির্ধারিত এই মূল্য কার্যকর করতে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি। এপ্রিল মাসের পর মে মাসের জন্যও একইভাবে দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি আরও একদফা ঘোষণা দেয় গত ২৯ এপ্রিল। কিন্তু এপ্রিলের পর মে মাসেও সরকার ঘোষিত দামের কোনও প্রভাব বাজারে পড়েনি এলপিজির বাজারে। সরকার নির্ধারিত দামের তোয়াক্কা না করে ব্যবসায়ীরা এলপিজির বোতল আগের দামেই বিক্রি করছেন।

গত ১২ এপ্রিল  বেসরকারি এলপিজির দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি ১২ কেজির বোতল ৯৭৫ টাকা। এই দাম এপ্রিল মাসের জন্য প্রযোজ্য ছিল। মে মাসে এসে এই দাম প্রতি ১২ কেজির বোতলে আরও ৬৯ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ৯০৬ টাকা। মে মাসের প্রথম দিন থেকেই এই দর কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, চলতি মাসের প্রথম তিন দিন চলে গেলেও ৯০৬ টাকায় দেশের কোথাও এলপিজি বিক্রি হচ্ছে না।

বিইআরসি বলছে, এই দাম কার্যকর হতে কিছুটা সময় লাগবে। এজন্য ভোক্তাদের অপেক্ষা করতে হবে।

এদিকে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বলে দিয়েছে— তাদের পক্ষে এই দামে এলপিজি বিক্রি করা সম্ভব নয়। এজন্য বেসরকারি এলপিজি কত দামে বিক্রি করলে উদ্যোক্তাদের সুবিধা হয়, তা জানিয়ে বিইআরসিকে চিঠিও দিয়েছে এলপিজি ব্যবসায়ীদের সংগঠন এলপিজি অপারেটস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব)।

অপরদিকে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন-ক্যাব এলপিজির দাম কমার কোনও আশাই দেখছে না। জ্বালানি বিভাগ বলছে, মাঠ পর্যায়ে তারা মনিটর করবে, যাতে করে ভোক্তার কাছে সরকার নির্ধারিত দামেই এলপিজি বিক্রি হয়। তবে তাদের এখনও এমন কোনও কাজের খবর জানা যায়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানী ঢাকায় সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া নির্ধারণের মতো হয়েছে বিষয়টি। সিএনজি চালিত অটোরিকশার জ্বালানি সিএনজি’র  দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি। কিন্তু অটোরিকশার ভাড়া আবার নির্ধারণ করে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়। দেখা গেছে, সিএনজিচালিত এই অটোরিকশা কখনও নির্ধারিত ভাড়ায় চলে না। সিএনজিতে উঠলেই মিটারের দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। সুতরাং, এলপিজির দাম নির্ধারণ করা, আর তা না মানার বিষয়টিও শেষ পর্যন্ত  নিয়ম রক্ষার ঘোষণাতেই পরিণত হয় কিনা, তা দেখার বিষয়।

এলপিজি অপারেটরদের সংগঠন লোয়াব থেকে বিইআরসিকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, বিইআরসি দর ঘোষণার সময় তাদের অনেক খাতের খরচকে বিবেচনা করেনি। এরমধ্যে রয়েছে— অপারেটরের মুনাফা ৮৯ টাকা, বিতরণ খরচ ২৫ টাকা, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার মুনাফা যথাক্রমে ২৪ টাকা ও ২৭ টাকা ধরা হয়েছে, এটি বাস্তবসম্মত নয়। ওভারহেড কস্ট ২৩ টাকার স্থলে ১৪৩ টাকা ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট খরচ ৪৮১ টাকার কথা বলেছিল লোয়াব, সেখানে বিইআরসি ১৯৪ টাকা অনুমোদন করেছে। এলপিজি শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় ১২ কেজি সিলিন্ডারের  ঘোষিত দর ৯৭৫ টাকার সঙ্গে আরও ২৮৭ টাকা যুক্ত করার দাবি জানায় লোয়াব।

লোয়াবের এই চিঠির জবাবে বিইআরসি বলেছে, ‘এপ্রিলে দাম ঘোষণার আগে বাজার যাচাই করে দেখা গেছে, ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডার ৯৩০ থেকে ৯৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কমিশন এনবিআরের সঙ্গে আলোচনার পর তিন ধাপে দেওয়া ১৫ শতাংশ মূসক কমিয়ে এনেছে। নতুন করে মুজতকরণ ও বোতলজাত পর্যায়ে পাঁচ শতাংশ এবং ব্যবসায়ী পর্যায়ে দুই শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর ফলে মূসক বাবদ ব্যয় আট শতাংশ কমে এসেছে। পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতা পর্যায়ে কোনও মূসক দিতে হবে না।

এত কিছু ছাড় দেওয়ার পরও বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজির দাম বোতল প্রতি হাজার টাকার নিচে নামছে না।’

এ বিষয়ে বিইআরসি’র চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ একটি নতুন বিষয়। এটি কার্যকর করতে কিছুটা সময় লাগবে। এজন্য সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। ভোক্তাদেরকেও সহযোগিতা করতে হবে। কমিশনের আদেশ অনুযায়ী, খুচরা বিক্রেতাদেরকে দোকানে দাম প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে। যারা নির্দিষ্ট দামে বিক্রি করছেন না, বা দাম প্রদর্শন করছেন না, তাদের বিরুদ্ধে কমিশনের কাছে অভিযোগ করতে পারেন ভোক্তারা।  সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কমিশন ব্যবস্থা নেবে।’ এজন্য সবাইকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে বলেও তিনি মনে করেন।

জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান এক বৈঠকে সম্প্রতি বলেছেন, বিষয়টি জ্বালানি বিভাগ মাঠ পর্যায়ে মনিটর করবে। যদিও এলপিজির বাজারে  তার এই বক্তব্যের  কোনও কার্যকরিতা দেখা যায়নি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছ্নে, গণশুনানি ছাড়া প্রতিমাসে কমিশনের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার বিষয়টি  আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এইভাবে দাম নির্ধারণ করা হলে ভোক্তারা এর কোনও সুবিধা পাবেন না। দাম আগের মতোই ব্যবসায়ীদের মর্জির ওপরে নির্ভর করবে। ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কমিশন যদি দাম নির্ধারণ করে, তাহলে সেই দামে বিক্রি হচ্ছে কিনা, সেটা দেখাও তাদেরই কাজ।  ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি না করলে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে হবে তাদেরই। এক্ষেত্রে দায় এড়ানোর কোনও সুযোগ নেই।’