গ্যাস নেই, বিকল্প ব্যবহারে বাড়তি খরচের বোঝা টানছেন গ্রাহকরা

সাধারণত শীতে গ্যাস সংকট দেখা দিলেও তা গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু এবার সেই চিত্র বদলে গেছে। শীত পেরিয়ে গরমেও গৃহস্থালিতে গ্যাসের হাহাকার যেন তেমনি রয়ে গেছে। গ্যাস সংকটে শিল্প-কারখানার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হলেও সাধারণ ভোক্তাদের ভোগান্তি নিয়ে কারও যেন কোনও মাথাব্যথা নেই।

আবাসিকে গ্যাস সংকট এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিতাসসহ গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো নিয়মিত বিল নিলেও সরবরাহ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। গ্রাহকরা গ্যাস না পেলেও নিয়মিত বিল পরিশোধ করছেন, অথচ কোনও পক্ষ এর দায় নিচ্ছে না। এমনকি দুঃখপ্রকাশ করতেও দেখা যাচ্ছে না।

সম্প্রতি জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাউজুল কবির খান বলেন, আবাসিকে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহের সম্ভাবনা নেই। তিনি বরং মনে করেন, আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলে সেটাই বরং ভালো হবে। কারণ সেখানে মূল্যবান গ্যাস অপচয় হচ্ছে।

এ অবস্থায় অনেকে বাধ্য হয়ে গ্যাসের বিকল্প হিসেবে বিদ্যুতের চুলা বা এলপিজি ব্যবহারে ঝুঁকছেন। ফলে একদিকে তারা নিয়মিত গ্যাস বিল দিচ্ছেন, অপরদিকে রান্না চালু রাখতে বাড়তি বিদ্যুৎ কিংবা এলপিজির খরচও বহন করতে হচ্ছে।

রাজধানীর মানিকনগরের বাসিন্দা সোমা চৌধুরী বলেন, ‘সকালে কিছুক্ষণ গ্যাস থাকলেও পরে আর পাওয়া যায় না। প্রতিদিন তো আর বাইরের খাবার খাওয়া সম্ভব না। তাই বিদ্যুতের চুলা কিনেছি। রান্না সহজ হলেও খরচ অনেক বেড়েছে। আগে যেখানে মাসে বিদ্যুৎ বিল আসতো এক থেকে দেড় হাজার টাকা, এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজারে। তার ওপর গ্যাসের দুই চুলার বিলও দিতে হচ্ছে ১ হাজার ৮০ টাকা। এর চেয়ে গ্যাসের লাইন না থাকলেই ভালো হতো।’

বনশ্রীর মনি ইসলাম জানান, ‘গ্যাস আসে সন্ধ্যার পর। কেউ যদি দুপুরে খেতে আসে, তাহলে আগের রাতেই রান্না করে রাখতে হয়। এরপর খাওয়ার সময় বিদ্যুতের ব্যবস্থায় গরম করে দিতে হয়। এতে সময় ও খরচ দুটোই বাড়ছে।’

রামপুরার জুনিয়া আহমেদ বলেন, ‘আমি চাকরি করি। সকালে বের হওয়ার আগে সারাদিনের রান্না করতে হয়। বিদ্যুতের চুলায় রান্না সময়সাপেক্ষ, তাই এলপিজি কিনে নিয়েছি। এখন গ্যাস লাইনের বিল তো দিতেই হয়, পাশাপাশি মাসে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা এলপিজির খরচও যোগ হয়েছে।’

দেশজুড়ে প্রতিদিনের গ্যাস চাহিদা প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট হলেও সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৮১৬ মিলিয়ন ঘনফুট। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যেখানে ২ হাজার ৪২০ মিলিয়ন ঘনফুট দরকার, সেখানে মিলছে মাত্র ১ হাজার ১৯ মিলিয়ন ঘনফুট— যা চাহিদার অর্ধেকেরও কম। সার কারখানায়ও ৩১৯ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ১১৯ মিলিয়ন ঘনফুট।

রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় স্বাভাবিক সরবরাহ বজায় রাখতে যেখানে প্রতিদিন ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দরকার, সেখানে এখন সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ১ হাজার ৫৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট।

তিতাস সূত্রে জানা গেছে, আগে তারা প্রতিদিন ১ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেলে পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক থাকতো। কিন্তু সম্প্রতি সরবরাহ আরও কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

না প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যতটুকু গ্যাস পাচ্ছি, ততটুকুই সরবরাহ করছি। আমাদের সরবরাহ ক্ষমতা সীমিত। দুইটি এলএনজি টার্মিনাল মিলিয়ে এখন প্রতিদিন ৯৯৭ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করছে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। কিন্তু দেশীয় গ্যাসের যোগান কমে যাওয়ায় এলএনজি বাড়িয়েও তেমন লাভ হচ্ছে না। এলএনজি আমদানির পাশাপাশি রি-গ্যাসিফিকেশন ও সরবরাহের পরিকাঠামো দরকার, যা সীমিত।’

প্রসঙ্গত, ২০২৬ সাল থেকে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন কমতে শুরু করবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগের সরকার দুটি ভাসমান রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট বসানোর সিদ্ধান্ত দিলেও অন্তর্বর্তী সরকার এসে তা বাতিল করে। ফলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে— এমন আশা করার সুযোগ খুবই কম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, ‘আমাদের অনেক গ্যাস লাইন পুরনো এবং সেখানেও সারা বছর সমস্যা থাকে। তাছাড়া যে পরিমাণ চাহিদা, সে অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে পারছি না। আবাসিকে গ্যাস দিলে শিল্পে সমস্যা হয়, আবার শিল্পে দিলে আবাসিকে সংকট দেখা দেয়। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরবরাহ বাড়ানো ছাড়া এই সংকটের কোনও স্থায়ী সমাধান নেই।’