প্রশ্ন, সংশয় আছে আরও। শুক্রবার রাত পৌনে নয়টায় ৭ জন সশস্ত্র জঙ্গি হঠাৎ করে আর্টিজানে ঢুকে দেশি-বিদেশিদের কুপিয়ে হত্যা করতে শুরু করলো, ব্যাপারটি কি এতই সহজ। তারা কি সেদিনই আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র, বিস্ফোরক নিয়ে গিয়েছিল? নাকি আস্তে আস্তে সেখানে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের মজুদ করা হয়েছে? এ ধরনের বড় অভিযানের ক্ষেত্রে সাধারণত ভেতরের কেউ না কেউ জড়িত থাকে। এক্ষেত্রেও কি তেমন কেউ ছিলেন? হলে তিনি কে? নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সেখানে সপরিবারে আটকা পড়া, রাতভর নিরাপদে থাকা, সকালে নিরাপদে বেরিয়ে আসা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। এই পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, হিজাব পরা ছিল বলে তাদের সম্মান করা হয়েছে, ভোররাতে সেহরি খেতে দেওয়া হয়েছে। সকালে ছেড়ে দেওয়ার আগে নাকি, জঙ্গিরা তাদের বলেছে, আপনারা চলে যান, আমরাও বেহেশতে চলে যাচ্ছি। জঙ্গিরা নাকি ছেড়ে দেওয়ার আগে তাদের নামাজ-রোজা করতে বলেছে। মনে হয়, ইসলাম ধর্মের স্পর্শকাতরতা ব্যবহার করে জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টির চেষ্টা ছিল। হামলাকারীদের মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ছিল। জিম্মি হওয়া সেই শিক্ষকও নর্থ সাউথের সেই বিভাগেরই। একই ঘটনায় ছাত্র হামলাকারী, শিক্ষক জিম্মি- এটা কি নিছকই কাকতালীয়? এমন অনেক প্রশ্নের জবাব হয়তো কখনোই আমরা পাবো না।
তবে আমার আজকের লেখা এই সব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে নয়। আজ আমি জানতে চাই, জঙ্গিরা কারা? বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা বিশেষ করে সাম্প্রতিক জঙ্গি কর্মকাণ্ডের স্টাইল একই। অদৃশ্য জঙ্গিরা এসে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে টার্গেটকে খুন করে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতো। আর আমরা সবাই মিলে মাদ্রাসা বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দায়ী করতাম। জঙ্গি নেতারা গ্রামের দরিদ্র ছেলেদের টোপে ফেলে জঙ্গি বানাতো বলে অভিযোগ করতাম। গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত তরুণরা অল্পতেই ইসলামের নামে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে তৈরি হয়ে যেতো বলে সন্দেহ করতাম। কিন্তু গুলশানের ঘটনা আমাদের এই প্রচলিত ধারণায় বড় ধাক্কা দিয়ে গেল। অবশ্য ছোট একটা ধাক্কা দিয়েছিল মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলার পর হাতেনাতে ধরা পড়া জঙ্গি ফাহিম। ঢাকার উত্তরার কলেজছাত্র ফাহিমের কাছ থেকে বিস্তারিত জানার আগেই পুলিশ তাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলে। তার মানে ছোট ধাক্কায় আমাদের ঘুম ভাঙেনি।
ফাহিমকে খুন করেই আবার ঘুমিয়ে পড়ি আমরা। তবে গুলশানের ঘটনা আমাদের অস্তিত্ব ধরেই টান দিয়েছে। আশা করি এবার আমাদের ঘুম ভাঙবে। গুলশানের ঘটনায় জঙ্গি হিসেবে যে কজনের নাম এসেছে তারা সবাই অভিজাত, সম্ভান্ত্র ও বিত্তশালী পরিবারের সন্তান। তারা স্কলাস্টিকা, টার্কিশ হোপ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান বা সাবেক ছাত্র। কেউ কেউ পড়াশোনা করতো মালয়েশিয়ায়। কারও বাবা ক্রীড়া সংগঠক, কারও বাবা ব্যবসায়ী, কারও মা শিক্ষক। সবাই সহজ স্বাভাবিক সমাজ ও পরিবারের সদস্য। কারও বিরুদ্ধেই অতীত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মাদকাসক্তি বা বখে যাওয়ার কোনও উদাহরণ নেই। বরং সবাই ভালো ছাত্র, ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত। নিহত নিবরাস ইসলামের ফেসবুক প্রোফাইল দেখলে কারও বোঝার উপায় নেই, এমন নির্মম হতে পারে সে। হিজাব না পড়ার অপরাধে ইশরাত আখন্দকে জবাই করা হয়েছে, এমন কথা ছড়ানো হলেও নিবরাসের টাইমলাইনে এমন অনেক গ্রুপ ছবি আছে, যেখানে নিবরাসের উচ্ছ্বল বন্ধু-বান্ধবীরা রয়েছেন। ভারতের অভিনেত্রী শ্রদ্ধা কাপুরের হাত ছুঁয়ে দেওয়ার ভিডিও আপলোড করেছি নিবরাস। তাতে সে লিখেছিল ‘ফিলিং পারফেক্ট’। এই বয়সের একটা ছেলে তার প্রিয় অভিনেত্রীর হাত ছুঁয়ে আপ্লুত হতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিক নিবরাসকে কে এমন অস্বাভাবিক করে তুললো? এত দ্রুত সে কিভাবে বেহেশতে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেল। কেন? কিভাবে? হামলায় যারা অংশ নিয়েছে, তারা ৪/৫ মাস ধরে মিসিং ছিল। বোঝা যাচ্ছে, তাদের ব্রেইনওয়াশটা আগেই হয়েছে। আর গত ৪/৫ মাসে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেই প্রশিক্ষণটা দেশে না বিদেশে জানা যায়নি এখনও। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তান ৪/৫ মাস ধরে লাপাত্তা হলেও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি কেন? তারা কি তবে জানতেন, কেচো খুড়তে গেলে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে। এখন যে অ্যানাকোন্ডা বেরিয়ে এলো, এখন পরিবারের সদস্যরা কিভাবে আড়াল করবেন এই গ্লানি।
জঙ্গি মানেই যে মাদ্রাসা ছাত্র নয়, এ ধারণা অনেক আগেই আমাদের দিয়েছে হিযবুত তাহরীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের নেতৃত্বে পরিচালিত হিযবুত তাহরীরের কর্মীদের বেশিরভাগই বেসরকারি ব্শ্বিবিদ্যালয়ের ছাত্র, আধুনিক, স্মার্ট, স্বচ্ছল পরিবারের সদস্য। গুলশান হামলায় প্রমাণিত হয়েছে, জঙ্গিরা প্রযুক্তিতেও দক্ষ। তারা রাতভর আর্টিজান থেকে সাইট ইন্টালিজেন্সে তথ্য পাঠিয়েছে। এমনকি লাশের ছবিও পাঠিয়েছে। তারা বরাবরই ভার্চুয়াল জগতে তাদের অভিযানের আপডেট দিয়েছে।
গুলশান অভিযানের পর একটা জিনিস পরিষ্কার- জঙ্গিদের খুঁজতে শুধু মাদ্রাসায় বা পাহাড়ে-পর্বতে যাওয়ার দিন শেষ। ঘরে বসে নিশ্চিন্তে বড় বড় বক্তৃতা দেওয়ার দিনও শেষ। আমাদের এখন ঘরে ঘরে খুঁজতে হবে। নিবরাস, রোহান, আন্দালিব, মোবাশ্বিররা আমাদের চারপাশেই থাকে। তাদের ফেসবুক প্রোফাইল দেখলে, তাদের টাইমলাইন ঘুরলে পরিচিত মনে হয়। আমাদের চারপাশেই তাদের বাস। আমাদের কারও কারও হয়তো পরিচিতও। আমার ছেলে পড়াশোনায় ভালো, ভালো স্কুলে পড়ে, কোনও বদভ্যাস নেই- এটুকু দেখে মধ্যবিত্তসুলভ নিশ্চিন্তে ঢেকুর তোলার দিন শেষ। মাদ্রাসার পাশাপাশি এখন নজর দিতে হবে আমাদের ঘরেই।
লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ