বিষয় হচ্ছে, ‘গুলশান অ্যাটাক’-এর জঙ্গিদের প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি সৃষ্টির, ‘ক্রাশ’ সৃষ্টির কিংবা 'স্টকহোম সিন্ড্রোম' সৃষ্টির একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সোস্যাল মিডিয়ায় জঙ্গিরা নাকি বলেছে যে, যারা বাংলায় কথা বলবে, যারা কোরান তেলাওয়াত করতে পারবে, তাদের খুন করা হবে না। একজনের স্ত্রী নাকি হিজাব পরায় খুশি হয়েছে জঙ্গিরা। তাকে নাকি সেহরিও খেতে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমি বলবো কতিপয় ধর্মান্ধ উন্মাদের খুশি হওয়ার অথবা অখুশি হওয়ার মধ্যে পার্থক্য করতে যাওয়াটাই হচ্ছে, সবচেয়ে বড় ‘আহাম্মকি’! অনেক সংবাদমাধ্যম এ ধরনের খবর আবার প্রকাশও করেছেন।
এ সব খবর প্রকাশের ফলাফল হচ্ছে, জনমনে জঙ্গিদের প্রতি 'স্টকহোম সিন্ড্রোম' সৃষ্টি! আর এই সব 'স্টকহোম সিন্ড্রোম' সৃষ্টিকারী এবং গ্রহণকারীরাই বলা যায়, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের প্রসার তথা মাত্র ঘটে যাওয়া 'গুলশান অ্যাটাক'-এর জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী।
যা ঘৃণ্য যা জঘন্য তার বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে ঘৃণার সঞ্চারণ করাটাই আসল মানবিকতার লক্ষ্মণ! আর নিরীহ মানুষকে খুন করার সমপর্যায়ের ঘৃণ্য- জঘন্য কিছু যে আর নেই, এটা দুনিয়ার সব ধর্ম, দর্শন আর বিজ্ঞানই স্বীকার করবে। এধরনের সর্বজনবিদিত ঘৃণ্য, জঘন্য কাজগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কিছুটা মহান কিংবা কিছুটা মানবিক করে চিত্রায়িত করার মধ্যে কোনো মানবিকতা নেই। বরঞ্চ অপরাধপ্রবণতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার ইঙ্গিত আছে।
আমাদের সবার মৌনতা অথবা নিষ্ক্রিয় ঘৃণা আসলে আমাদের সবার জীবনকেই প্রকারন্তরে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তার চেয়ে আসুন সবাই সক্রিয়ভাবে বলি যে, আমরা জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করি। এর সঙ্গে যে কোনোভাবে সম্পৃক্তরাও কোনো যুক্তিতেই ঘৃণার ঊর্ধ্বে যেতে পারে না এবং প্রমাণিত জঙ্গিদের পরিবারদেরও জঙ্গিবাদবিরোধী মিছিলে জায়গা করে দিন। এতে নতুন জঙ্গি সৃষ্টি হওয়া বন্ধ হবে, পুরনো জঙ্গিরাও নৈতিক সমর্থন হারিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে।
দয়া করে জঙ্গিদের অনুগ্রহ না দেখিয়ে খুন হয়ে যাওয়া নিরীহ নিহত স্বজনদের অনুগ্রহ করতে শিখুন। যারা মনে মনে ভাবছেন যে, জঙ্গিরা ঠিক কাজটিই করছেন, যারা ভাবছেন ইসলাম এই নিরীহ মানুষ হত্যাকে সিদ্ধ করেছে বা বৈধতা দিয়েছে, তারা চরম ভুল বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছেন। পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট বর্ণিত আছে, ‘একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করার শামিল এবং একজন নিরীহ মানুষের প্রাণ বাঁচানো সমগ্র মানব জাতির প্রাণ বাঁচানোর শামিল’। (আল কোরআন সুরা ৫, আয়াত ৩২)
কেউ যদি নিজেকে পবিত্র কোরআনের সত্যিকার অনুসারী ভেবে থাকেন, তাহলে তার প্রথম কাজটি হওয়া উচিত সেই সব জঙ্গিদের প্রতি তার মৌন সমর্থন তুলে নেওয়া, যারা ইসলামী শাসন কায়েমের যুদ্ধ বা জিহাদের নামে সমগ্র মানুষ হত্যা করছে। পবিত্র কোরআনের অনুসারীর দ্বিতীয় দায়িত্বটি হওয়া উচিত ইসলামী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়ে সমগ্র মানব জাতির প্রাণ বাঁচানোর সমান পূণ্য অর্জনের বন্দোবস্ত করা।
বাংলাদেশের ৯৯.৯৯% মানুষই শান্তিপ্রিয় মানুষ। এরা কখনোই কোনো জঙ্গি প্রক্রিয়ায় ইসলামী বিপ্লব সংগঠনের স্বপ্ন দেখেন না!
তাহলে এ দেশে জঙ্গিদের তৎপরতা থামানো যাচ্ছে না কেন? বিষয়টি ব্রিটেনে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ব্রেক্সিট () গণভোটের সঙ্গে তুলনীয়। ব্রিটেনে ব্রেক্সিট-এর পক্ষে যারা ভোট দিয়েছেন, তাদের একটা বড় অংশ মানুষের কোনও স্পষ্ট ধারণাই ছিল না যে, ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ফলাফল কী হতে পারে। বাংলাদেশের সিংহ ভাগ মানুষই আসলে এ বিষয়ে সচেতন নন যে, কেন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া উচিত। কিন্তু একবার যদি এদেশের মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করে তোলা যায়, তাহলে নিশ্চিত করেই একথা বলা সম্ভব যে, সামাজিক চরম প্রতিকূলতার মুখে এদেশে কোনও অভ্যন্তরীণ অথবা বাইরের শক্তি-ই জঙ্গিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না। এটাই প্রকৃত সত্যি।
উপমহাদেশের পাকিস্তান অথবা তৎসংলগ্ন আফগানিস্তানে জঙ্গিবাদের চাষাবাদ যতটা সহজে সম্ভব, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের চাষাবাদ করাটা ততটাই কঠিন। বিষয়টি যত দ্রুত তাদের মাথায় ঢুকবে,যারা এদেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের চাষাবাদ করতে চান, ততই সবার জন্য মঙ্গল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরেই যদি পাকিস্তানি আর্মি আত্মসমর্পণ না করতো, তাহলে পাকিস্তান আর্মি শুধু যুদ্ধে পরাজিতই হতো না, সেনাবাহিনীর ৯০ হাজারের বেশি সদস্যের প্রাণ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনাটি ছিল খুবই ক্ষীণ। পাকিস্তান আর্মির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিজেই এ ধারণা পোষণ করেছেন সাম্প্রতিক কালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে।
ইতিহাস দেখেছে, তুমুল পরাশক্তি আমেরিকাকে ফিরে যেতে হয়েছে কিউবা থেকে, ভিয়েতনাম থেকে যুদ্ধ জয় না করেই। এমন কি এই যে, ইরাককে বোমা মেরে তামা বানিয়ে ফেলা হয়েছে, সেই ইরাকেও কি বিদেশি সৈনিকেরা শান্তিতে অবস্থান করতে পেরেছেন? পারেননি। যে কোনও যুদ্ধে বা বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টপক্ষগুলোর মধ্যে সম্ভাব্য পরাজিত পক্ষ তার সম্ভাব্য পরাজয়ের বিষয়টি কিংবা বিজয়ী হওয়ার অসম্ভবতার বিষয়টি যত দ্রুত উপলব্ধি করে, উভয় পক্ষের জন্য তো বটেই পৃথিবীর জন্যও বিষয়টি ততই মঙ্গলজনক হয়।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদের ঘটনাগুলোর সঙ্গে কথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সত্যিকার যোগাযোগ থাকুক আর নাই থাকুক, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদের ঘটনাগুলো অভ্যন্তরীণ অথবা আন্তর্জাতিক যে ধরনের রাজনীতির সাথেই সম্পৃক্ত থাকুক না কেন, এ কথা হলফ করে বলে দেওয়া যায় যে, ইসলামী জঙ্গিবাদ কিংবা উগ্র ধর্মীয় শাসন এ দেশে সদা অপ্রতিষ্ঠিত থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাটিই আসলে তীব্র। এর প্রধান কারণ, বাংলাদেশের মানুষ কোনও বিদেশি অথবা আমদানিকৃত ধ্যান-ধারণাকে খুব সহজে গ্রহণ করতে কখনোই রাজি নয়।
হাজার বছর ধরে হরেক রকম ভিনদেশি এই বঙ্গে আসা-যাওয়া করলেও, নানান জাতের ভিনদেশি এই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিগ্রহণ করলেও কোনও ভিনদেশিই তাদের ভাষা বা সংস্কৃতি বঙ্গের মানুষের ওপর শত ভাগ কেন সিকি ভাগও চাপিয়ে দিতে পারেনি। এর একটি বড় কারণ হয়ত এই যে, বাংলা অঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতির শেকড় অনেক গভীরে বিস্তৃত।
এত গেল সাংস্কৃতিক-নৃতাত্ত্বিক কারণ। এবার নজর দেওয়া যাক, ভূ-প্রাকৃতিক কারণের দিকে। ভূ-প্রাকৃতিকভাবে বাংলার ভূখণ্ড সমতল। এক পার্বত্য চট্টগ্রাম বাদ দিলে পুরো বাংলাদেশটাকেই সমতল বলা চলে। ময়মনসিংহ কিংবা সিলেট অঞ্চলের টিলাগুলোও খুব দুর্গম ভূখণ্ড নয় যে, মানুষের চোখ এড়িয়ে এখানে জঙ্গিরা অপ্রতিরোধ্য দুর্গ কিংবা স্থায়ী কোনও ট্রেনিং ক্যাম্প গড়ে তুলতে পারবে।
এছাড়াও ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ কোনও মুসলিম দেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত নয়। তাই, এ সব দেশ থেকে ইসলামী জঙ্গিরা আদর্শগত, নৈতিক , অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক আশ্রয়জনিত সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে যদি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর সবাই কিংবা প্রায় সিংহভাগেরও বেশি মানুষ যদি জঙ্গি প্রশ্নে অভিন্ন অবস্থান নেয়,তাহলে কোনও জঙ্গিরই সাধ্য নেই যে,গুপ্তহত্যা ঘটিয়ে পালিয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের হাতে জঙ্গিদের ধৃত আর প্রহৃত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় প্রায় শতভাগ।
আসলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনের ও সমূলে উৎপাটনের প্রায় সব উপাদানই রয়েছে। এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে নাগরিকদের জঙ্গিবাদবিরোধী মনোভাবের সচেতন সক্রিয় এবং আন্তরিক বহিঃপ্রকাশ। নাগরিকমনে কোনওভাবেই ‘স্টকহোম সিন্ড্রোম’ তৈরি হওয়ার সুযোগ না দেওয়াটাও জরুরি। দুটি বিষয়েই সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি রাখতে হবে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোকেই।
দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় একটি ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। দেশের সব মসজিদ আর ইসলামিক প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয়ভাবে জঙ্গিবাদবিরোধী উগ্র ইসলামী মনোভাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া উচিত ছিল, এক যুগেরও বেশি সময় আগে যখন প্রথম ইসলামী জঙ্গিরা বাংলাদেশে তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল। এতদিনেও যদি তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করা গিয়ে থাকে, তাহলে কালবিলম্ব না করেই সরকার বিশেষ ‘মনিটরিং সেল’ তিরি করে হলেও এ বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এটাও খুব জরুরি সিদ্ধান্ত যে, বাংলাদেশে ধর্মকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক দল থাকার প্রয়োজন আছে কী নেই। জনগুরুত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্তটি নেওয়ার জন্য হয়ত একটি গণভোটই হতে পারে সবচেয়ে গণতান্ত্রিক এবং গ্রহণযোগ্য উপায়।
সরকারের আর যে কাজটি না করলেই নয়, তা হচ্ছে দেশে বহুমাত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে সবার জন্য একই ‘কারিক্যুলাম’ অনুসরণ বাধ্যতামূলক করে তোলা। প্রয়োজনে শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যম বা নির্দেশনার ভাষা একাধিক হতে পারে। কিন্তু কারিক্যুলাম যেন অভিন্ন হয়। শেষোক্ত বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে শুধু জঙ্গিবাদ সমস্যা নয়। বাংলাদেশের বিদ্যমান অসংখ্য সমস্যার অর্ধেকেরই বেশির সমাধান হয়ে উঠবে কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার।
যাই হোক, একথা সত্যি যে, খুব ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ ও বিশ্বাস কিংবা বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক শ্রেণির মানুষের বসবাস। কিন্তু ইতিহাসের নানান বাঁকে সময়ের প্রয়োজনে এই বাংলাদেশের সব মানুষ কাঁধে -কাঁধ মিলিয়ে এক সঙ্গে সব প্রতিকূলতাকে পরাভূত করেছে, তার উদাহরণ আছে। সময়ের প্রয়োজনে বাংলাদেশের সব মানুষ সচেতনভাবে জঙ্গিবাদবিরোধী সম্মিলিত প্রয়াস তৈরি করতে মোটেও দ্বিধাগ্রস্ত হবে না। শেষ পর্যন্ত জয় হবে বাংলার শান্তি প্রিয় মানুষেরই।
জয় হোক, আবহমান বাংলার শান্তি-প্রিয় মানুষের। সমূলে নিপাত যাক দুর্বৃত্তের ধর্মীয় জঙ্গিবাদ !
লেখক: আইনজীবী এবং উন্নয়ন গবেষক
ই-মেইল- shawn.law@hotmail.com
আরও পড়তে পারেন: আইএস-এর উপস্থিতি স্বীকার করাই কি সমাধান?