অথচ এদেরই সবার চোখে জ্বলজ্বল করছে যেন সহিংসতায় সক্ষমতার অপার আনন্দ। পেছনে জ্বলজ্বল করছে আইএস-এর কালো পতাকা, গায়ে ‘আত্মত্যাগের’ কালো পোশাক, মাথায় ‘আরব যোদ্ধার’ বিশেষ অর্থবহ কায়দায় ফেটি বাঁধা, হাতে একে শ্রেণির স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। খুব নিশ্চিত বাকি সব ছাপিয়ে তাদের প্রত্যয়ী হাসিতে উদ্ভাসিত উজ্জ্বল মুখগুলো কাঁটার মতোন বিঁধছে ভীষণ সবার মনে।
এমন অস্বস্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে একজন মানুষ তখনই, যখন সে পুরোপুরি জানতে পারবে - কী করে কী হলো যে এরকম কয়েকজন তরুণের দ্বারা এমন নৃশংস একটা ঘটনা ঘটানো সম্ভব হলো। এর শতভাগ নির্ভেজাল জবাব বা তথ্যসম্ভার কারোই প্রাপ্তিতেই জুটবে না। তবু সত্য সন্ধানটি অস্তিত্বরক্ষার প্রয়োজনে একান্তই আবশ্যক।
প্রথমেই আসা যাক আইএস পতাকা আর তাদের ট্রেডমার্ক পোষাকের প্রসঙ্গে। আজ বিশ্বের প্রায় সব মানুষই জানে এটা যে, আইএস হলো মোসাদের একটা সংগঠন যারা সিরিয়ায় যুদ্ধে পিছু হটলে মরমে মারা যায় ইসরায়েলের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। আরও জানে সবাই যে, সংগঠনটির জন্ম মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি তত্ত্বাবধানে ও প্রশিক্ষণের সহযোগিতায়, কর্তা ব্যক্তিদের অনুমোদনে। শুধু কি এই? ইসলামি খেলাফত কায়েমে বদ্ধপরিকর এ সংগঠনটির শীর্ষ নেতা প্রকৃতপক্ষে একজন ইহুদি, যে তার একান্ত সঙ্গী ও অনুসারী সহ (যাদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত নয়া মুসলিম) মার্কিন বিশেষ কৃপা ও মদতপ্রাপ্ত। ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রাণান্ত এ সংগঠনের ভেতর ইসলামি চর্চাটি মোটামুটিভাবে অনুপস্থিত। কারণ তারা সেই মুসলিম যারা একবিংশ শতাব্দীতে হাজার নারীকে যৌনদাসী করে রেখেছে, যার প্রতিবাদ করলে শিরশ্ছেদ করছে, অর্থের জোগানের জন্যে এই যৌনদাসীদের নিলামে তুলছে। এরপর আর কি প্রশ্ন থাকে এরা মুসলিম নাকি মুসলিম না সে বিষয়ে! অথচ ইসলামের নামে মগজধোলাই করে সারা পৃথিবী থেকে ওরা রিক্রুট করে যাচ্ছে তাদের জিহাদি যোদ্ধা। কী নারী, কী পুরুষ নির্বিশেষে। পাশাপাশি অন্য যে কোনও ব্যক্তি বা সমষ্টি ইসলামের নামে সন্ত্রাস ঘটাতে চাইলে তাদের অনুমোদন, সহায়তা, মদত, অর্থায়ন, অস্ত্র সরবরাহ, ঘটনার পর পরই (যেন মহান নেক হাসিলের বাহবা নেওয়ার জন্য মরিয়া তারা) দায় স্বীকার করার জন্যে ওরা এক নয়, দশ কদম এগিয়ে আছে। পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমও লহমায় লোমহর্ষক অন্যায়কে পৃথিবীময় প্রচার করে তাদের হিরো বানাচ্ছে।
এসবের সূত্র ধরে আইএস পতাকা, জিহাদি পোশাক, হাস্যোজ্জ্বল 'আত্মত্যাগের' ছবি, কিংবা রক্তের পুকুরে ভিকটিমের মরদেহের ছবি - তড়িৎ গতিতে আইএস উদ্যোগে ওয়েবে আপলোড হলে এসবের যোগসূত্র আর অস্পষ্ট থাকে কী করে! আজকের দিনে মুক্ত প্রযুক্তি ও অতি সহজলভ্য ইন্টারনেট সুবিধা যথেষ্ট মাত্রায় এগিয়ে দিচ্ছে তাদের। এ তথ্যপ্রযুক্তির ওপর ভর করে আইএস অনেক কিছুই করে যাচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। কিন্তু হাতের ওই অস্ত্র? ওটা কি ওয়েব আপলোড বা ইমেইলের ভেতর দিয়ে এসে পৌঁছে গেছে ঢাকার এই তরুণদের হাতে? এদেশের কারও সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া এটা ম্যাটার ট্রান্সমিশন সুবিধার কল্যাণে ওদের হাতে এসে পৌঁছায়নি নিশ্চিত। তাহলে কোন পথে? সেই সূত্রটাই গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে খুঁজে বের করতে হবে। বের করতে হবে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।
চারপাশে সবার কথায় একই বিস্ময় প্রতিধ্বনিত, মাত্র চার-ছয় মাসে হাসি খুশি প্রাণবন্ত স্বাভাবিক একটা ছেলে কী করে এমন নৃশংস খুনে সন্ত্রাসীতে পরিণত হলো। মানুষ মাথা ঘামাচ্ছে হিপনোটাইজিং ইফেক্ট সম্পন্ন ওষুধ নিয়ে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে এটা স্রেফ হিপনোটাইজিং ওষুধ প্রতিক্রিয়া নয়। এটা নিশ্চিত ভাবেই একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এই ছেলেগুলো নিখোঁজ থাকার এই চার-ছয় মাস গোটা প্রক্রিয়ার একটা অংশ মাত্র। আমি বলবো- এটা গোটা প্রক্রিয়ার পঞ্চম ধাপ।
প্রথম ধাপে রিক্রুটিং গ্রুপ তরুণদের মাঝে তাদের পছন্দসই মানুষগুলোকে খুঁজতে থাকে। তাদের টার্গেট ১৬/১৭ থেকে ২২/২৩ বছরের তরুণ। উল্লেখ্য- খেয়াল করলে দেখা যাবে এমন হামলাকারীদের বয়স থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১৮ থেকে ২৮ এর মধ্যে। এক অর্থে সে বয়স বলতে টিনএজের শুরুটা বোঝালেও টিনএজের শেষ সময়ের অধিক উদ্দাম ও আবেগপ্রবণ সময়টাকেই সবচেয়ে বেশি ভালনারেবল হিসেবে প্রাধান্য দিতে হবে। এই বয়সে ‘আমিত্ব’ সবচেয়ে আধিপত্যে থাকে অনেকের ভেতর। সেই সঙ্গে তার কল্পজগতের ডানাটি সবচেয়ে জোরালো। কিছু একটা করে ফেলার উদ্দামতা, হিরোইজম সিন্ড্রোম সবচেয়ে জোরদার। এই ভাবাবেগে ভাসমান সন্তানটিকে আগলে রাখতে গিয়ে বাবা-মা অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বিরাগভাজন মানুষ। তার ওপর আছে পুঁজিবাদের ইঁদুর দৌড়ের ফলস্বরূপ সন্তানদের সঙ্গে কর্মযুদ্ধে মরিয়া বাবা-মায়ের দূরত্ব কিংবা পারিবারিক অশান্তিকে ঘিরে সন্তানদের সংসার বিমুখতা। এমন কোনও না কোনওভাবে ভাবাবেগ তাড়িত এক লেট টিনের সাথে দু'লাইন পিঠে হাত বোলানো কথা বলে ভালো-মন্দের দেখভাল করার মতো বুলি আউড়ে তার কাছে ভেড়াটা মোটেও কঠিন নয়। বিশেষ করে মানসিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অন্যকে কুক্ষিগত করে নেওয়া বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন কোনও মানুষের পক্ষে।
দীর্ঘদিন ধরে তরুণদের সঙ্গে মিশে তাদের সঙ্গে খাতির জমানো, মনের ভেতর আবেগ উচ্ছ্বাস ক্ষোভ ক্রোধ এসবের উৎস ও মাত্রা পরিমাপ করা প্রথম স্তরের কাজ। কার দুর্বলতা, ভাল লাগা, খারাপ লাগা কী; কার পরিবারে শান্তির পরিবেশ, পরিবারকে ঘিরে কার কতোটা অসন্তোষ, এসব খুঁজে বের করে ডাটা ফিড ইন করা প্রথম পর্বের কাজ। আমাদের দেশে এর জন্য ইন্টারনেটের পাশাপাশি আছে সরাসরি মানুষের সম্পৃক্ততার সুযোগ। পৃথিবীর অনেক দেশে যদিও এটা ঘটছে স্রেফ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই।
দ্বিতীয় ধাপের কাজ হলো বাছাইকৃতদের সঙ্গে খাতিরটা এমন মাত্রায় জমানো, নতুন বন্ধুটিই যেন হয়ে ওঠে তরুণটির আপন মা-বাবা ভাই বোনের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও কাছের। তরুণটিকে অধিক হারে প্যাম্পার করে, তার নানা কাজে প্রসংশা করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে খুব সহজেই মনস্তাত্ত্বিক ভাবে ঘায়েল করা এই পর্বের মুখ্য কাজ। পিতা-মাতা বা পরিবারের সদস্যরা যে শাসন আর বিধি-নিষেধ আরোপ করবে তা এরা করবে না। আবার সরাসরি কোনও খারাপ কাজে মত কিংবা মদতও দেবে না। ইসলাম কায়েম করা আদপে এদের মূল উদ্দেশ্য না হলেও ইসলাম নিয়ে সুন্দর কথা বলবে ওরা। এ পর্বে সহিংসতা বা অনুরুপ প্রসঙ্গকে সেভাবে টেনে আনবে না। নৈতিক অনৈতিকের চেয়ে বিরাগভাজন না হওয়াটাই এদের কাছে মুখ্য বিচার্য।
তৃতীয় ধাপের কাজ হলো- দ্বিতীয় ধাপে ঘনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য সম্পর্ক স্থাপিত তরুণদের মাঝে মানসিকভাবে নাজুকতা ও নির্ভরশীলতার মাত্রাকে ইসলামের নামে দিওয়ানা বানানোর মতো একটা স্তরে নিয়ে যাওয়া। ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠায় মন্ত্রের নামে চলতে থাকে মগজধোলাই। প্রাণের বিনিময়ে হলেও ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতেই হবে, এমন প্রতিজ্ঞায় মরণপণ করিয়ে তবে এ পর্বের শেষ।
চতুর্থ ধাপে আসে পরিপূর্ণ জিহাদি বানাবার পর্ব, আত্মঘাতী হওয়ার সকল মন্ত্রে দীক্ষা দেওয়ার পর্ব। যখন সেই তরুণটি নির্দেশ পাওয়া মাত্রই প্রাণ দিতে প্রস্তুত। যখন তার মধ্যে সেই নির্দেশকে ঘিরে কোনও প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা পরিপূর্ণভাবে নিখোঁজ। এমন কী যা আর জেগে উঠবার সম্ভাবনা নেই। এই চতুর্থ পর্বের সফল সমাপ্তি যাদের ভেতর ঘটানো সম্ভব হয় তাদের তখন স্বাভাবিক জীবন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় বিশেষ প্রশিক্ষণ পর্বে।
পঞ্চম ধাপে চলে এই সামরিক প্রশিক্ষণ পর্ব। কমান্ডো ট্রেনিং-এর চেয়ে কোনও অংশে কম যায় না এই ধাপ। এই পর্বেই সে শেখে অস্ত্রের ব্যবহার। দীক্ষিত হয় নির্দ্বিধায় অপরাধী কী নিরপরাধ বিবেচনা ব্যতিরেকে মানুষ কতল করবার মন্ত্রে। নির্দেশটুকুই কেবল তার দরকার। যুক্তি বা বিচারের কোনও প্রস্তাবনা এখানে আর অবশিষ্ট নেই। এক কথায় বলা যায় এই পঞ্চম পর্বের শেষে যাকে আপনি পাবেন সে অনেকাংশে একজন রোবট।
সবগুলো পর্বেই সব কিছুর পাশাপাশি তাকে শেখানো হয় বিবিধ রকম পরিস্থিতিতে কেমন করে সহজ স্বাভাবিক সাধারণ জীবনযাত্রা ও আচরণের মোড়কে সহজাত থাকতে হবে, নিতান্তই কাছের মানুষটিরও চোখে ধুলা দিয়ে। ব্যাপারটা এই নয় যে এই তত্ত্ব বা এমন ঘটনা কেবল বাংলাদেশেই ঘটছে। আমেরিকা কি ইংল্যান্ড সবজায়গায় ঘুরে ফিরে এই একই নোটেশনে চলছে র্যাডিকেলাইজেশন প্রসেস।
এতো সব ধাপে না রাষ্ট্র ব্যবস্থা না পরিবার পূর্ণাঙ্গ অনুপ্রবেশ ক্ষমতা রাখে একটা তরুণের জীবন ও মনস্তত্বে। এখানে পরিবার ও রাষ্ট্রের পাশাপাশি প্রতিবেশী আত্মীয় বন্ধু ও স্বজন সবারই ভূমিকা রাখার অত্যাবশ্যকীয়তা আছে। আছে সহপাঠী ও শিক্ষকদের। কথা হলো এমন সামাজিক সম্পৃক্ততার সুযোগ কি আজ আদৌ বিদ্যমান আছে? যা স্বাভাবিক ভাবেই সমাজে বিদ্যমান ছিল আজ থেকে চার বা পাঁচ দশক আগে।
তাহলে উপায়? হতাশ না হয়ে আজ থেকে উল্লেখিত সব আঙ্গিকে সচেষ্ট হওয়াটা তাই বড্ড বেশি জরুরি। উদাসীন না থেকে প্রতিটি খুটিনাটি বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে প্রতিটি কিশোর ও তরুণকে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। সন্তান যাদের সঙ্গে মিশছে তাদের হাল-হদিস জানা বাধ্যতামূলক। সন্তানের সঙ্গে এ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলার মতো সম্পর্কটি বজায় রাখা তাই খুব জরুরি।
এতো সব দায়িত্ব করণীয় সব গুরুজন, বাবা মা, শিক্ষক আর রাষ্ট্রেও জন্য ভীষণ জরুরি এই কারণে যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সুস্থ সবল ও সঠিক করে বাঁচিয়ে রাখার ও বড় করার দায়িত্বটি সেই শিশুটির নয়, আমাদের। আর সে বিপথে গেলে বা সন্ত্রাসী হলে, খুনি হলে, জঙ্গি হলে - বাবা মা, প্রতিবেশী, সমাজ সমষ্টি বা রাষ্ট্রের কোনই ফায়দা নেই, থাকে শুধু দায়।
তাহলে ফায়দা কার? কারও না কারও ফায়দা না থাকলে এসব তবে ঘটছে কেন? কার স্বার্থে? এদেশ অস্থির থাকলে, আত্মবিশ্বাসী না থাকলে যার লাভ তারই স্বার্থে। অন্য কারও নয়।
কথা হলো এই অকারণ নির্মমতা আজ সারা পৃথিবীর সমস্ত ভূখণ্ডের মাটিকে রঞ্জিত করেছে। বাদ যায়নি দেবালয়ও। তবু আমাদের ঘরে হলেই কেবল মোড়লদের বা দেবতাদের মাথা ব্যাথা হয় বেশি। তাই কারও মুখাপেক্ষী হওয়ার বা কারও ওপরে নির্ভর করার মতো বিষয় এটি নয়।
একান্তই আমার আপনার এগিয়ে আসার বিষয়। রাষ্ট্রযন্ত্রও তখন চাইলেও নির্বিকার বসে থাকতে সক্ষম হয়ে উঠবে না বা ভুল পথে চলতে পারবে না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক