পশ্চিমবঙ্গে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসুর একমাত্র ছেলে চন্দন বসুও ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন। তার সম্পর্কেও ছোট ছোট কিছু দুর্নাম ছিল। চন্দন বসু ঠিকাদারী ব্যবসা করতেন। মার্গারেট থেচার ব্রিটেনের দুই দু’বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাকে ‘লৌহ মানবী’ বলা হতো। তার স্বামী থেচার সম্পর্কেও কিছু কিছু কথা যে লন্ডন শহরে আলোচনায় আসেনি তা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হওয়ার সুবাদে কোনওখানে পুকুর চুরির কোনও ঘটনা এখনও চোখে পড়েনি। বাংলাদেশের মতো প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ‘হাওয়া ভবন’ খুলে বসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্যারালাল অফিস চালানোরও নজির নেই।
জওহর লাল নেহরুর স্ত্রী কমলা নেহরুর এক ছোট ভাই ছিল। লেখা পড়া ইন্টারমিডিয়েট পাস। রোলিং স্টোন-এর মতো ঘুরেছেন। নেহরু একটা চাকরি দেননি। অবশ্য আমার মনে হয় সাধুতার নামে এটা নেহরুর শ্যালক শ্রেণির প্রতি বেশি নির্মমতা। একটা ছেলেকে নিজের ঘরে বসে বসে খেতে দেব আর অকর্মণ্য করে ফেলার সুযোগ দেব, নিজের প্রাইভেট সেক্রেটারি এম ও মেথাইকে দিয়ে বেসরকারি কোনও প্রতিষ্ঠানেও একটা চাকরির ব্যবস্থা করাবো না- এইটা তো কোনও একজন প্রধানমন্ত্রীর মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গি নয়। সাধু ব্যক্তিরা অনেক সময় নির্মমও হয়।
ব্রিটেনের এক প্রধানমন্ত্রী ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট-এর বাসা ছেড়ে দেওয়ার পর তিন শত কি.মি. দূরে তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন। কারণ লন্ডন শহরে তার কোনও বাড়িঘর নেই।
বিহারের এক হরিজন মুখ্যমন্ত্রী শেষ বয়সে গ্রামে গিয়ে গৃহস্থলী করে জীবন চালিয়েছেন কারণ এ ছাড়া তার জীবন নির্বাহের অন্য কোনও উপায় ছিল না। এমন সৎ মানুষের ফিরিস্তি দিলে বহু দিতে পারি। তবে বাজার অর্থনীতি মানুষের অর্থ উপার্জনের লোভ এমন জোরালো করে ফেলেছে যে, মানুষের হিতাহিত জ্ঞান রহিত হয়ে গেছে।
বিহারের এক মুখ্যমন্ত্রীর কথা একটু আগে উল্লেখ করেছি। আবার বিহারের আরেক মুখ্যমন্ত্রী পশু খাদ্যের ১১ শত কোটি টাকার সম্পূর্ণ টাকাই আত্মসাত করেছেন। বিচারে তার দশ বছরের জেল হয়েছে।
যাহোক, লিখতে বসেছিলাম বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিচার এবং শাস্তি সম্পর্কে। আলোচনা করার জন্য সেখানে প্রাসঙ্গিক ও অপ্রসাঙ্গিক অনেক কথাই লিখলাম। তারেকের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করলেও ওই অপরাধে তারেক রহমানের যুক্ত থাকার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা যায়নি বলে মনে করেছিলেন নিম্ন আদালত। সেই বিচার পর্যালোচনা করে প্রায় আড়াই বছর পর উচ্চ আদালত রায় প্রদান করে বলেছেন, ‘তারেক সচেতনভাবে এই আর্থিক অপরাধের অংশ ছিলেন তাই তিনি কোনও ধরনের ছাড় পেতে পারেন না।’ বিচারিক আদালত তারেক জিয়াকে বেকসুর খালাস দিয়েছেলেন। হাইকোর্ট সে রায় বাতিল করে তাকে আইনটির সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছর কারাদণ্ড দিলেন এবং ২০ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করলেন। তারেকের বিচার হয়েছে পলাতক আসামি হিসাবে। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জামিনে মুক্তি পেয়ে ভাঙা কোমরের চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়ে আর ফেরত আসেননি। এখন বাংলাদেশে উপস্থিত হওয়া ছাড়া সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা সম্ভব নয়। তার বিরুদ্ধে আরও তিনটি গুরুতর মামলা রয়েছে। ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হত্যা মামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা। হুমায়ূন কবির সাব্বির হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে ২১ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার মামলা। এ তিনটা মামলাও গুরুতর অপরাধের মামলা। প্রমাণিত হলে ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হত্যা মামলায় অনেকের সঙ্গে তারেকের ফাঁসির আদেশও হয়তোবা হতে পারে। কারণ এ মামলায় জজ মিঞা নাটক সাজিয়ে এক চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। তখন বেগম জিয়ার ক্ষমতায় তাদের সম্পৃক্ততা না থাকলে জজ মিঞা নাটকের অবতারণা করার চেষ্টা হলো কেন? যে কারণেই হোক, তারেক জিয়ার দেশে ফিরে এসে মামলা মোকাবিলা করার মানসিকতাও নেই, নৈতিক শক্তিও নেই। ২০১৯ সালের নির্বাচন পর্যন্ত তিনি দেশে আসবেন না এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি জিতলে তবে হয়তো তার আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
আরও একটা বিষয় অনেকের সঙ্গে আমিও উপলব্ধি করেছি যে, তারেক জিয়ার সাজা হওয়ায় বিএনপির বহু নেতা-আনন্দিত হয়েছেন। হাওয়া ভবনে ডাকলে মন্ত্রীদেরকে যেতে হত অনেক কথার জবাব দিতে হত, তখন থেকেই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নেতারা তার ওপর বিরক্ত। হাওয়া ভবন খুলে তারেক জিয়া সব কিছুরই সীমা অতিক্রম করেছিলেন। সীমা লংঘনের ফলাফলতো কখনও ভালো হয় না। সীমা লংঘনকারী সম্পর্কে আল্লাহরও হুশিয়ারি আছে। আমরা খুবই ব্যথিত হয়েছি তারেকের পক্ষের উকিলদের আস্ফালনে।
একজনতো বলে ফেললেন আমরা রায় শুনে স্তব্ধ হয়েছি। এ মামলায়তো তারেকের সাজা হতে পারে না। ভাবখান এমন সরকার যেন রায় প্রদানে কোর্টকে প্রভাবিত করেছেন।
আরেকজন বড় আইনজীবী বললেন, ২০ কোটি টাকা হোসাফ মিটার আর নির্মাণ প্রকৌশলী কনসালটেশন ফি হিসাবে গিয়াস উদ্দীন আল মামুনেকে প্রদান করেছেন। গিয়াস উদ্দীন আল মামুন কত বড় বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞ তাকে ২০ কোটি টাকা ফি পরিশোধ করতে হয়েছে। এ ২০ কোটি টাকা সিঙ্গাপুরের যে ব্যাংক একাউন্টে জমা হয়েছে তাতে সে একাউন্ট থেকে টাকা গিয়াস উদ্দীন আল মামুনও তুলতে পারেন, তারেক জিয়াও তুলতে পারেন।
এ মামলার মাজেজা তারেক পক্ষের আইনজীবীরা না বুঝলেও হাইকোর্টের বিচারকেরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। অনেক সৎ আইনজীবী এমন চুরি-চামারির মামলায় সম্পৃক্ত হতে চান না। এরশাদের মামলায় যখন হাইকোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী সিরাজুল হক সাহেব যেতে বাধ্য হলেন তখন তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলির সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করে রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন।
রাজনীতি একটা মহৎ পেশা। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে তিনি এরশাদের ‘চুরিচামারি’র মামলায় নিজেকে জড়িত করতে চাননি। অথচ তারেকের পক্ষের আইনজীবীরা, যারা আবার রাজনীতিও করেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে, বলছেন ২০ কোটি টাকা নাকি কনসালটেশন ফি। শেক্সপিয়ার আইনজীবীর প্রতি কটাক্ষ করে তার নাটকে বলেছেন, ‘এই সে জিহবা যা সত্যকে বিধ্বস্ত করে ফেলে।’
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক