গত বৃস্পতিবার তেল, গ্যাস, বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির বিক্ষোভ সমাবেশ পুলিশি শক্তি প্রয়োগ করে পণ্ড করে দেওয়ার পর সচেতন মহলে সঙ্গত কারণেই ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে বয়ে যাচ্ছে ক্ষোভের ঝড়। ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি জনগণের প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে জনগণের কথা শুনতে সমস্যা কোথায়? জনগণ তার কাছে যাবে, তিনি জনগণের কথা শুনবেন, এইটাই তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’— এমন মন্তব্য করেছেন তেল, গ্যাস, বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বিদেশিদের স্বার্থ রক্ষা করতে সরকারের ও কোম্পানির বেতনভুক্ত কিছু অসাধু ব্যক্তি ভুল তথ্য দিয়ে জনগণ ও প্রধানমন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য কতটা যে ক্ষতিকর তা না বুঝিয়ে উল্টাটা বোঝাচ্ছেন। ন্যূনতম যাদের কাণ্ডজ্ঞান আছে তারাও বুঝবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে। কিন্তু সরকারের এ সব আমলাদের কথা শুনলে মনে হয় তাদের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উচিত জনগণের কথা শোনা, কিন্তু তাদের দ্বারা বেষ্টিত যারা কাঠ কয়লা আর খনিজ কয়লার পার্থক্য বোঝে না। প্রধানমন্ত্রী তাদের কথা শুনছেন।
আনু মুহাম্মদ যেসব কথা বলেছেন, তা বাংলাদেশের অনেক সচেতন মানুষের অভিমতের প্রতিধ্বনি। সরকারের উচিত, এসব বক্তব্য ও যুক্তি আরও ভালোভাবে খতিয়ে দেখা। তা না করে গায়ের জোরে সবার সব মতামতকে দমন করলে এর পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য। বাংলাদেশের জনগণ অতীতে বহুবার প্রমাণ করেছে যে, তাদের ন্যায্য সংগ্রাম নিপীড়নে দ্বিগুণ জ্বলে ওঠে। এভাবে হামলা করে, পুলিশ দিয়ে, জনমতকে উপেক্ষা করে কোনোভাবেই এ ধরনের বিতর্কিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত হবে না। আর জনমতের বাইরে গিয়ে, পুলিশের শক্তির ওপর ভর করে কখনোই পার পাওয়া সম্ভব নয়।
দেশ-বিদেশের অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনের সমূহ ক্ষতি হবে। তাহলে সুন্দরবন ধ্বংসী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নে সরকার কেন এত মরিয়া? এতে দেশের কী এমন উপকার হবে? আর পুলিশ দিয়েই বা কেন এই আন্দোলন দমন করতে হবে? প্রধানমন্ত্রী কী পারেন না, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে? তাদের যুক্তিগুলো শুনে সরকার পক্ষের যুক্তিগুলো উপস্থাপন করতে? তা না করে লাঠি-টিয়ারগ্যাস ব্যবহার করে সরকার কেন কিছু মানুষের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ-আন্দোলনকে দমন করতে চাইছে?
এমনিতেই আমাদের দেশে জাতীয় স্বার্থে প্রতিবাদ-আন্দোলন বড় বেশি হয় না। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে তাদের যাবতীয় কার্যক্রম সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচিও এখন সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যনির্ভর। এই বাস্তবতায় বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে ‘তেল, গ্যাস, বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির’ কার্যক্রম নিঃসন্দেহে একটা আশাবাদের জায়গা। এই সংগঠনটি গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন ও জনমত সৃষ্টির কাজটি করে যাচ্ছে। তারা যুক্তি দিয়ে তাদের বক্তব্য উপস্থান করছে। সরকারেরও উচিত তাদের বক্তব্যগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা, যুক্তি দিয়ে তাদের বক্তব্য খণ্ডন করা। সহানুভূতিশীল আচরণ করা। তা না করে জঙ্গি কায়দায় যদি তাদেরও দমন করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে আখেরে দেশেরই ক্ষতি হবে। দেশ থেকে প্রতিবাদ আন্দোলন হারিয়ে যাবে। এটা গণতন্ত্রের জন্য বিরাট অশনিসংকেত।
তেল, গ্যাস, বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির আন্দোলনের সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা বেশিরভাগই বাম ঘরানার মানুষ। তাদের সঙ্গে আরও রয়েছেন সচেতন ছাত্র-যুব-নারী আর সংস্কৃতিকর্মীরা। সংখ্যাগত দিক থেকে তাদের হয়তো উপেক্ষা করা যায়, কিন্তু তাদের দেশপ্রেমকে কিছুতেই অগ্রাহ্য করা যায় না। এই আন্দোলনের কর্মীদের বেশিরভাগই সাধারণ জীবনযাপন করে, চাকরি করে, সংসার করে, বাজার সদাই করে, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। সব কিছুর পর তারা মাঝে মাঝে তেল-গ্যাসের জন্য মিছিল-মিটিং করে। এখন তারা যদি এর পুরস্কার হিসেবে পুলিশের লাঠির বাড়ি ও টিয়ার গ্যাসও খায়, তাহলে দেশে ভবিষ্যতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য একটি লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাজেই সুন্দরবন রক্ষার পাশাপাশি ‘তেল, গ্যাস, বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটি’কে জাতীয় স্বার্থেই বাঁচিয়ে রাখা দরকার।
আর জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে দেশবাসীকেও আরও বেশি সচেতন ও সম্পৃক্ত হতে হবে। অন্তত যারা ‘সচেতন মানুষ’ বলে নিজেদের দাবি করেন, তাদেরও মধ্যবিত্তসুলভ সুবিধাবাদিতা ত্যাগ করতে হবে। ফেসবুকে লিখে ফাটিয়ে ফেলব, চায়ের কাপে ঝড় তুলব, বামপন্থী-ডানপন্থী-মধ্যপন্থী সবার সুবিধাবাদ ও দালালিকে তুলাধুনা করব, অথচ নিজে কোনও প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হবো না-এটা কোনও কাজের কথা নয়। আন্দোলন ছাড়া, লড়াই ছাড়া পৃথিবীতে কোনও কিছু অর্জন করা যায় না।
আন্দোলনকারীদেরও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ‘তেল, গ্যাস, বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটি’র মিছিলে কেন মাত্র হাজার-বারো শ মানুষ উপস্থিত হয়? কেন এই গুটিকয় ব্যক্তিই পুলিশি নির্যাতন ভোগ করে? এই দেশটা তো ১৬ কোটি মানুষের। তাহলে বাকিরা নীরব কেন? নাকি এই এক-দেড় হাজার জনের বাইরে আর কারও তেল গ্যাসের দরকার নেই? সুন্দরবন রক্ষার গরজ নেই? যদি হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ পথে নামে, তাদের দাবি যদি ন্যায্য হয়, তাহলে পুলিশ-র্যাব-আর্মি কোনও কিছু দিয়েই তাদের ঠেকানো সম্ভব না।
সমস্ত সুবিধাবাদিতা আর অবিমৃষকারীতার ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের দেশপ্রেম আর সুস্থ ধারার রাজনৈতিক আন্দোলনের শিখাটিকে অবশ্যই জ্বালিয়ে রাখতে হবে। এই শিখা নিভতে দেওয়া যাবে না। কারণ আমাদের সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর ঘোরতোর প্রতারণা আছে, আঘাত আছে। দেশ ভেতরে ভেতরে জ্বলছে। যারা নিঃস্বার্থ লড়ছে, তারা আপাতত দুর্বল, কিন্তু নিঃসহায় নয়। যারা দেশকে প্রগতির পথে নিয়ে যায়, ধ্বংসের পথ থেকে ফিরে আসার পথ দেখায় তাদের লড়াইয়ে আমরাও লড়ে যাই, কিছুটা বাঁচি কিছুটা মরি। কখনও পিছু হটি, আবারো লড়ি।
পরিশেষে সুমনের গানের ভাষায় বলব- হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে…!
লেখক: কলামিস্ট
আরও খবর: হাসনাত করিম কোথায়?