আমেরিকামুখী ভারত!

5814ea3712e25184b61616c03a23c894-Shuvo-Kibriaএক সময় আমেরিকার চোখ ছিল পাকিস্তানের দিকে। পাকিস্তানকে বন্ধু বানিয়ে এই অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভুত্বের বিরুদ্ধে লড়েছে আমেরিকা। আফগানিস্তানে রাশিয়া সমর্থিত সরকার এবং কম্যুনিস্টদের উৎখাত করতে পাকিস্তানেই ঘাঁটি গেড়েছিল আমেরিকা। এই কম্যুনিস্টবিরোধী লড়াইয়ে ইসলামপন্থিদের জিহাদি জোশের অস্ত্র, অর্থ সরবরাহ এসেছিল খোদ মার্কিনিদের কাছ থেকে। পাকিস্তান ছিল তার মাধ্যম। পাকিস্তানে এফ-১৬ বোমারু বিমান বিক্রি করে প্রতিবেশি ভারতকে চাপে ফেলেছিল তখন আমেরিকা। আশির দশকের সেই রাজনীতি এখন নেই। পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে রাজনীতির সেই গতিমুখ। পাকিস্তানের সঙ্গে সেই প্রেমময় মাখামাখি সম্পর্ক নেই এখন আমেরিকার। পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার ভালবাসাময় রাজনৈতিক সম্পর্কের পুরোপুরি বিচ্ছেদ ঘটেনি বটে, তবে দু’দেশের প্রেমের তালে এখন ভাটির টান। এবং সেই প্রেমময় উত্তেজনার অতীত দিনের জোশের ফসল হিসেবে পাকিস্তানে ‘জঙ্গিবাদ’এখন আমেরিকান উপহার। আমেরিকা ও পাকিস্তানের উত্তুঙ্গ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ফসল হিসেবে ‘জঙ্গিবাদ’ শুধু পাকিস্তানকেই পেছনে টানেনি গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এক অগ্নিময় বিপদকে জান্তব করেছে।
০২.

এখন সেই পাকিস্তানপ্রেম থেকে মুখ ফিরিয়েছে আমেরিকা। দক্ষিণ এশিয়ায় নতুনভাবে ভারতপ্রেমে মশগুল আমেরিকা। একসময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমেরিকায় সফর করতে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছে আমেরিকা। এখন সেই নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেই মোদিই ইতোমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমেরিকায় চার চারবার রাষ্ট্রিক সফর সেরেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ভারতে এসেছেন। ভারত ও আমেরিকার বড় বড় মন্ত্রিরা প্রায়শই দু’দেশ সফর করছেন। সম্প্রতি আমেরিকায় সফররত ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী
মনোহর পারিকর আমেরিকান প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টারের সঙ্গে এক অসাধারণ চুক্তিও স্বাক্ষর করেছেন। পেন্টাগনে অ্যাশ কার্টার ও মনোহর পারিকর সামরিক সহযোগিতার যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সই করেছেন, তার নাম লজিস্টিক একচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অফ আর্টিকেল বা এলইএমও। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে দু’দেশ নানা প্রয়োজনে একে অন্যের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। সামরিক ও মানবিক প্রয়োজনে ভারতের আকাশ, নৌ, বিমান পথে বাধাহীন ব্যবহারের সুযোগ পাবে আমেরিকা। যৌথ মহড়া, সামরিক সরঞ্জাম জোগান, জ্বালানি তেল রিফুয়েলিং সহ দু’পক্ষের সামরিক অংশের মধ্যে থাকবে বাধাহীন সহযোগিতা। এই চুক্তির আওতায় ভারতের মাটিতে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ ছাড়া আর সব রকম সামরিক সহযোগিতাই পাবে আমেরিকা। এই চুক্তির বড় দিক হচ্ছে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রযুক্তি উদ্ভাবনে দু’দেশ পরস্পরকে সহায়তা করবে। প্রতিরক্ষা বাণিজ্যে, সমরাস্ত্র উৎপাদনে ভারত-আমেরিকা এখন যৌথ ব্যবস্থা নিতে পারবে। ইতোপূর্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যে সমঝোতায় পৌঁছেন, তার আওতায় ভারতে ব্যাপক বিনিয়োগ করবে আমেরিকা। এই বিনিয়োগের একটা বড় অংশ হবে প্রতিরক্ষা খাতে। যৌথ উদ্যোগে সমরাস্ত্র উৎপাদন হবে ভারতে, আমেরিকান বিনিয়োগে। নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রিক ও ব্যক্তি খাতে এই বিনিয়োগ সহজ করতে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ নীতিমালাতেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। ফলে এটা এখন প্রকাশ্য সামনের দিনগুলোতে ভারতে উৎপাদিত ভারত-মার্কিন যৌথ বিনিয়োগে উৎপাদিত অস্ত্র খুঁজবে নতুন বাজার।

 ০৩.

আমেরিকায় বসে যখন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সামরিক সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করছেন, ঠিক তখন ভারতে সফর করেছেন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। বারাক ওবামা প্রশাসনের মেয়াদকালের শেষ সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ঘুরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ভারতের এক গুরুত্ববহ দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত ও বাণিজ্য ডায়ালগে অংশ নেন। ভারত ও আমেরিকা গত এক দশকে বাণিজ্য ও স্ট্র্যাটেজিক খাতে পরস্পরকে বিশেষ সুবিধা দিতে এই কৌশলগত চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। কৌশলগত, সামরিক, বাণিজ্যিক, উদ্ভাবনী, প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক খাতে উভয় দেশ যে দ্বিপাক্ষিক গাটছাড়া বেঁধেছে, তাতে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক এক নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে। এখন দেখার বিষয় মার্কিনিদের এই আগ্রহের হেতু কী? আর ভারত এই সুমধুর মার্কিনপ্রেম থেকে কী সুবিধাই নেবে?

এক. মার্কিন থিংক ট্যাংক বারাক ওবামা প্রশাসনের শাসনামলে যে দীর্ঘমেয়াদি পররাষ্ট্রনীতি নিয়েছে তার মূল কথা হচ্ছে ‘লুক ইস্ট’। পূর্ব দিকে মনোযোগ দাও। বাড়ন্ত অর্থনীতির, সম্ভাবনার, বিকাশমান এশিয়ার অর্থনীতির সুবিধার অংশীদার হতে চায় আমেরিকা। এশিয়ার বৃহৎ দেশ হিসেবে, আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত তাই আমেরিকার বড় পছন্দ।

দুই. এখনকার কূটনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাণিজ্য ও সামরিক সুবিধা। ভারতের বৃহৎ বাজার আমেরিকার কাছে শুধু লোভনীয় নয়, একে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী রূপ দিতে পারলে তা মার্কিন অর্থনীতিকে নতুন দিশা দিতে পারে। বিশেষত প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্র বাণিজ্যে ভারতকে কেন্দ্র করে যে বৃহৎ বাজার তৈরি করার সুবিধা আছে, তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে চায় আমেরিকা। সে কারণেই ভারত, এখন আমেরিকার প্রথম পছন্দ।

তিন. এই অঞ্চলের সমুদ্রপথ, খনিজসম্পদ, কৌশলগত সামরিক সুবিধা দিতে একটা শক্ত অবস্থান চায় আমেরিকা। প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে রুখতে একটা শক্তিমান আঞ্চলিক মিত্রও দরকার আমেরিকার। এই বিবেচনায় ভারত হচ্ছে সবচাইতে সুবিধাজনক স্থান। অন্যদিকে আমেরিকায় থাকা ৩০ লাখ শিক্ষিত ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান, যারা এখন আমেরিকার নাগরিক এবং আমেরিকার শিক্ষা-প্রযুক্তি-বাণিজ্য-বিজ্ঞান খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, এই শক্তিমান অংশটিকেও নতুন উদ্দীপনায় ব্যবহার করতে চায় আমেরিকা। ভারতপ্রীতির সেটাও একটা বড় কারণ আমেরিকার জন্য।

০৪.

এটা তো গেল আমেরিকার দিক। ভারত কেনো এই নতুন দিক বদল ঘটাতে চাইছে তাদের পররাষ্ট্রনীতির। যে ভারত যুগের পর যুগ জোটনিরপেক্ষ নীতিতে এগিয়েছে সেই ভারত হঠাৎ করে আমেরিকার দিকে এত ঘন হয়ে ঝুঁকছে কেন? কারণ;-

এক. ভারত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও শক্তিমান ভূমিকা রাখতে চায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য হতে খুবই আগ্রহী ভারত। ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা

দক্ষিণ এশিয়ার মুরুব্বি হিসেবে নিজের ভূমিকাকে টেকসই করা। আর্থিক ও সামরিক শক্তিতে চীনকে ঠেকিয়ে আরও উঁচুতে উঠতে চায় ভারত। ভারতের এই অগ্রযাত্রায় চাই একজন শক্তিমান পরাশক্তির প্রত্যক্ষ মদদ। রাশিয়ার সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। তাই পুরনো বন্ধু রাশিয়াকে পেছনে ফেলে এখন আমেরিকার বন্ধুত্ব তার চাই-ই চাই। সে কারণেই প্রায় ন্যাটো সদস্যদের মর্যাদা নিয়েই আমেরিকার সাথে সামরিক ও বাণিজ্যিক গাটছড়া বাঁধতে দরজা খুলে দিয়েছে ভারত।

দুই. উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থার আওতায় নতুনধারার অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগ পেতে আগ্রহী ভারত। নরেন্দ্রমোদির ‘ মেক ইন ইন্ডিয়া’ আওয়াজ আমেরিকান ঘরানার ইন্টেলেজেনসিয়ার মাথা থেকেই আসা। ভারতে আসো , বিনিয়োগ করো , বাজার বাড়াও -এই খোলা নীতির আওতায় প্রচলিত শিল্পায়নের বাইরে সমরাস্ত্র বাণিজ্যের বিকাশমান বাজারে ঢুকতে চায় ভারত। সে কারণেই তার দরকার একটা পরাশক্তি বন্ধু। প্রয়োজন শক্তিমান অংশীদার। সেই প্রয়োজনই তাই অবশ্যম্ভাবি করে তুলেছে আমেরিকার সহায়তা। সেটা পেতেই ভারত তার আকাশ , নৌ, স্থল আমেরিকাকে খুলে দিতে মনস্থির করেছে।

তিন. ৯/১১-এর পর পৃথিবীব্যাপী ইসলামি জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছে । দক্ষিণ এশিয়া তার ব্যতিক্রম নয়। এই ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে ‘ওয়ার অন টেরর’লড়াইকে একটা বাণিজ্যিক চেহারা দিতে পেরেছে আমেরিকা। এই বাণিজ্য থেকে সুবিধা নিতে চায় ভারত। সেখানেও আমেরিকার সাথে গাঁটছড়াবাধার একটা আপাত লাভ আছে। সেটাকে কাজে লাগিয়েছে ভারত। আমেরিকান মিত্রতার সেটাও একটা বড় কারণ।

চার. ভারতের অর্থনৈতিক চেহারা বড় হচ্ছে। তার সাথে বাড়ছে ভারতের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাও। প্রতিবেশি দেশগুলোর ওপর এক ধরণের প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা ভারতের প্রকাশ্য। নেপাল , বাংলাদেশ , শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ভারত সেই সামর্থ্য দেখিয়েছে। আঞ্চলিক শক্তি ভারত ক্রমশ আন্তর্জাতিক শক্তি হয়ে উঠতে আকাঙ্ক্ষি। এই আকাঙ্ক্ষার টেকসই বাস্তবায়ন দেখতে হলে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ভারতকে আরও বড় হয়ে ওঠতে হবে। এই বড় হয়ে ওঠার জন্যও দরকার আমেরিকার মতো মিত্রের ঘনসান্নিধ্য।

০৫.

একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় আমেরিকামুখিনতাই এখন ভারতের অভীষ্ট লক্ষ্য। এর পরিণাম কী , এর ভালো-মন্দ কী সেটা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে। ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষত রাষ্ট্রক্ষমতায় কট্টর মৌলবাদী হিন্দুত্ববাদ জায়গা নিয়েছে। ভারতীয় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় হিন্দুমৌলবাদের বড় ধরনের উত্থান ঘটেছে। ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ সর্বত্র এই র‌্যাডিকালাইজেশন বা জঙ্গিত্ব প্রাতিষ্ঠানিক শক্ত ভিত পেয়েছে। এই কট্টরপন্থা ভারতের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজকে কতটা টেকসই সুস্থিরতা দেবে সেটাও বিবেচ্য। এই ক্ষত নিয়ে আমেরিকান মিত্রতা ভারতকে আগামী দিনে কতোটা খুশিতে রাখবে তা বলা মুশকিল। তবে আপাতত এটুকু বলা যায় আমেরিকামুখী ট্রেনে ভারতের এই নবযাত্রা চলবে জোরেই। বেশ জোরেই।

লেখক: সাংবাদিক