আত্মধিক্কার


একাত্তর টিভির পরিচালক (বার্তা) সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাসিলেটে ছাত্রলীগ নেতার চাপাতির আঘাতে গুরুতর জখম শিক্ষার্থী খাদিজার চিকিৎসা চলছে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে। গত সোমবার বিকেলে কলেজ ক্যাম্পাসে ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থীকে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী বদরুল। এই বদরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক। যখন কুপিয়েছে তখন কেউ তাকে থামাতে যায়নি, পরে সহপাঠীদের কয়েকজন ধাওয়া দিয়ে বদরুলকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে দিয়েছে। আর এক গ্রুপ ব্যস্ত থেকেছে জখম করার দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করার কাজ যা পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনার দিনই পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইন্সট উইমেন সার্ভে ২০১৫’ প্রতিবেদন। জরিপে দেখা যাচ্ছে, দেশে বর্তমানে বিবাহিত নারীদের ৮০ শতাংশই কোনও না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন।
সোমবারই আবার বিশ্বব্যাংক জানালো, বাংলাদেশের অতি দারিদ্র্য পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। দেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। সাত বছরের ব্যবধানে প্রায় ৮০ লাখ হতদরিদ্র লোক অতি দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে, গত অর্থবছর শেষে অতি দারিদ্র্য হার দেশের মোট জনসংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে এ হার ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ।
দারিদ্র্য কমছে। কিন্তু যদি নারী-নিগ্রহে দেশ ওপরের দিকে স্থান করে নিতে থাকে, তাহলে উন্নয়নের ছোঁয়াটা লেগেছে কোথায়? নারী নির্যাতন, নারী পাচার, ধর্ষণের এই অগ্রগতিকে আর যাই হোক, ঠিক ‘উত্তরণ’ বলা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ একটি অগ্রসরমান দেশ। সামাজিকভাবে সচেতন ও প্রগতিশীল একটি সক্রিয় জনগোষ্ঠীও আছে আমাদের। আমাদের উন্নয়নের (মূলত আর্থিক প্রবৃদ্ধি) বিষয়টিও আলোচিত। কিন্তু সেখানে যদি নারী নিগ্রহের হার এমন হয় তবে বুঝতে হবে, আমরা দারিদ্র্য কমাতে পারলেও রক্ষণশীলতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্নতা হতে মুক্ত থাকার দাবি করতে পারছি না। যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতাই সে সযত্নে লালন করে। শিক্ষা ও প্রগতির ভাণ তাকে এই প্রবণতাগুলো লুকিয়ে রাখতে শিখিয়েছে, এই যা। দরিদ্র মানুষের প্রতি মনোভাব ও আচরণে যেমন, তেমনই নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে ও আচরণেও এই সমাজ রীতিমত প্রতিক্রিয়াশীল।
সিলেটে যে ঘটনাটি ঘটলো, তার পরিপ্রেক্ষিতে একটিই প্রতিক্রিয়া সম্ভব আর তা হলো: তীব্র আত্মধিক্কার। যে দেশে এই একবিংশ শতকে এমন প্রকাশ্য পাশবিকতা ঘটতে পারে, আর মানুষেরা সকলে মিলে সেই নির্যাতন উপভোগ করতে পারে, সেই দেশের নাগরিক বলে পরিচয় দিতে গিয়ে আত্মধিক্কার ছাড়া আর কোনও অনুভূতি হয় না। আধুনিক, অগ্রসরমান বাংলাদেশের লজ্জা হয়ে রইলো এই ঘটনা।
সমাজের সর্বস্তরে, শহরে গ্রামে মফস্বলে সর্বত্র নারীর নিরাপত্তা যে কত স্বল্প, প্রায়ই তার দৃষ্টান্ত পাই আমরা। নারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা যে দ্রুত গতিতে বাড়ছে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব ছাড়াও তা বোঝা যায়। প্রতিদিনকার সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে তার প্রমাণ অজস্র। এই অপবৃদ্ধির অনেক কারণ আছে। একটি কারণ শক্তিধর আর ক্ষমতাসীনদের দাপট। তারা মনেই করে কিছু হবে না তাদের। আরেকটি হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শৈথিল্য। পুলিশের তরফে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে না-চাওয়া, অভিযোগ পেয়েও দুস্কৃতিকারীদের গ্রেফতারে টালবাহানা, অহেতুক বিলম্ব করার মধ্যে সেই মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়ে ঘটনা যখন সর্বজনীন ধিক্কার সংগ্রহ করে এবং সরকার তথা প্রশাসনকে ভীষণ অস্বস্তি ও লজ্জায় ফেলে দেয়, কেবল তখনই রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের চাপে পুলিশ তৎপর হয়। বিষয়টি অনেকটা এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে, রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষও সহসা তৎপর হয় না যতক্ষণ না সামাজিক ও গণমাধ্যম হইচই করছে।
একদিকে চরম প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের উত্থান, অন্যদিকে রাজনৈতিক ও সমাজিক শক্তির নির্লিপ্ততা মেয়েদের পোশাকের দৈর্ঘ্য কতটা হবে, কত রাত পর্যন্ত তারা বাইরে যাতায়াত করতে পারবে, পুরুষ-অভিভাবক না নিয়ে মেয়েদের রাস্তা-ঘাটে বের হওয়া উচিত কিনা, এখনও এসব বাংলাদেশের সমাজের বিবেচনার বিষয়। রাষ্ট্র নারীদের প্রশাসনে এবং রাজনীতিতে যোগদানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে, অর্থনীতিও উন্মুক্ত বাজারে নারীদের শ্রম এবং উৎপাদনকৌশলের মর্যাদা দিতে অনাগ্রহী নয়। কিন্তু সমাজ ও পরিবার নারীদের কেবল পিছিয়ে রাখতে চায়। অর্থনীতিসহ নানা সূচক আর পরিসংখ্যানে এগুতে থাকা সমাজ কেবলই পিছিয়ে পড়ছে মন-মানসিকতায়। প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির বিকাশ এমনই যে, নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধই এ দেশে একমাত্র অপরাধ, যেন অপরাধের শিকার যারা, তাদের দোষত্রুটি, সম্ভাব্য স্খলনই জনসমাজের, এমনকি প্রশাসনেরও চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে।
সিলেটে ওই ছাত্রলীগ নেতা যা করেছে, তা শুধু নারী নির্যাতন নয়, বৃহত্তর সামাজিক অন্যায়ের একটি প্রকাশ। এ ধরনের ঘটনাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং তার প্রতিকার করা রাষ্ট্রের জন্য জরুরি। শাসক দলের নেতা, তাই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর একধরনের প্রবণতা থাকে। তারা শুধু নয়, বিচার হয় না বলে, অনেক সাধারণ অপরাধীও দাগী হয়ে ওঠে অপরাধ করে শাস্তি না পেয়ে। আমাদের মনে রাখতে হবে শাস্তির কঠোরতার চেয়েও শাস্তির নিশ্চয়তা অপরাধীদের নিরস্ত করে বেশি।
লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি