ষোলো কোটি উপদেষ্টা!

শারফুদ্দিন আনামডিজিটাল জাতির অংশ হতে কে না চায়? আমরাও চাই। শুধু চেয়েই ক্ষান্ত থাকি না, আমাদের হাত থেকে শুরু করে স্ট্যাডিরুমের টেবিল হয়ে বাড়ির দেয়ালের এলইডি—প্রতিটি স্থান গ্যাজেটে পরিপূর্ণ। ঘরে-বাইরে ইন্টারনেটের জাল বিছানো জীবন। তাতে ভরা মৌসুমের ইলিশের চেয়েও কোটিগুণ বেশি ধরা পড়ছে তথ্য। একইসঙ্গে  ভালোমন্দ মিলিয়ে আমাদের দিচ্ছে তৃপ্তি ও সন্তুষ্টি। কারণ ২০১৬ সালে এসে মলাটবন্দি গ্রন্থভুক্ত জ্ঞানের পাশাপাশি আমাদের সমসাময়িক অনেক বিষয়ে  প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জানতে হচ্ছে, জানাতেও হচ্ছে। জ্ঞানের বাজারে গতকাল যা নতুন মুকুলের ঘ্রাণ ছড়িয়েছিল, আজ ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে তা কতটা বাসিপচা গন্ধ ছড়াচ্ছে, নিজেকে সময়োপযোগী ও একইসঙ্গে যুগোপযোগী প্রমাণ করতে, তাও আমাদের মাথায় রাখতে হচ্ছে।
তো সমস্যা কোথায়? হাতে গ্যাজেট আছে, মনে আকাঙ্ক্ষা আছে, জিনগতভাবে পাওয়া অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসের চর্চা আছে, সুশিক্ষার পাশাপাশি ঝুলিতে অগণিত অর্ধশিক্ষা আছে, মগজে কুসংস্কারে ভরা বাল্যদীক্ষা আছে। হলফ করে বলতে পারি, কথায়-কথায় উপদেশের ডালি সাজিয়ে বসা কারও কারও শৈশবের শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে ঢুঁ দিলে আজও পরীক্ষাপাসের জন্য পেন্সিলে আঁকা দেয়ালিকা খুঁজে পাওয়া যাবে। তাতে কী, তাতে তো আর বিশেষজ্ঞ হওয়া ঠেকবে না। কারণ হাতের তালুতে গ্যাজেট, পকেটে ১০/২০ টাকা, ম্যাসেজবক্সে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের শর্তসাপেক্ষ ইন্টারনেট এমবি কেনার অফার। আর সবশেষে গ্যাজেটের মনিটরে আছে ওপেন করা স্যোশাল মিডিয়া। আর আমরা বেশ একটা বিজ্ঞভাব ধরে একটি হাত পকেটে রেখে মাথা ঝাঁকিয়েই চলছি—হচ্ছে না, কারও কিছুই হচ্ছে না। শুধু ভেবেই ক্ষান্ত দেইনি, ১০ টাকা খরচ করে যে এমবি কিনেছিলাম, নগদে তা ব্যবহার করে লিখেও ফেলছি—উহু, এভাবে না ওভাবে, এটাই ভুল, ওটাই ঠিক। ব্যস, মুহূর্তেই আমরা বনে গেলাম বিজ্ঞ উপদেষ্টা।
এত কথা কেন বলছি? বলছি কারণ, এর সবই তো রোজ দেখছি। আর যা দেখছি, তাই তো এখন লিখছি। মানবতাবিরোধী অপরাধের  বিচার প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই স্যোশাল মিডিয়াকে সরব হতে দেখেছি। উত্তাল সে সময়ে সাধারণ মানুষ যেমন বিচারের পক্ষে বাহবা দিয়েছেন, তেমনি কিছু ‘না-সাধারণ’ ব্যক্তি অতীত না ঘেঁটে বর্তমানকে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা তো কম হয়নি ফেসবুকে। সমালোচনা খুব ভালো লাগে যদি তা গঠনমূলক হয়। তা যদি কোনও যোগ্য ব্যক্তি করেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি হওয়া কয়েক শ’ কোটি টাকা উদ্ধারে এমন অনেক পরামর্শদাতা দেখেছি, যারা এখনও খুচরার বদলে ১ টাকার অ্যালপেনলিব বা কফি চকোলেট আঙুল শাসিয়ে আদায় করেন। কাউকে খাটো করে দেখার উদ্দেশ্যে এটা বলছি না, উল্টো বলছি হ্যাঁ, কাউকেই খাটো করে দেখা আমাদেরও উচিত নয়।

তদন্ত কমিটির প্রধান কী তদন্ত করলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় এখনও কেন সব ফেরত আনতে পারলো না, এভাবে এগোলে কোনও দিন কিছু হবে না, ওভাবে এগোলেই চুরির দিন মাঝরাতেই হ্যাকার বাসায় এসে পায়ে ধরে সরি বলতো—ব্যাপারটা কি এমন? এগুলো নিয়ে হুট করে না বুঝেই বিশেষজ্ঞ অভিমত দিলে দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষগুলো এবং তাদের অভিজ্ঞতাকেই খাটো করা হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, যারা যে দায়িত্বে আছেন, তারা ভিন্ন কোনও কারণে কখনও কখনও দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়তো হতে পারেন, কিন্তু তারা অবশ্যই জ্ঞানহীন নন। 

জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনার সময় জনমনে সে কি উত্তেজনা! মনে পড়ে? আমরা কফির মগে ফুঁ দিতে দিতে কিংবা গলির মোড়ের চায়ের দোকানে আধাকাপ চায়ের সঙ্গে ২টা টোস্ট ভিজিয়ে খেতে খেতে, কিভাবে অভিযান পরিচালনা করা সঠিক হতো, এতক্ষণ কী কী বিশাল ভুল হয়ে গেল, বিশেষায়িত বাহিনীর কিংবা মিডিয়ার— সেই উপদেশ লিখে পোস্ট করে দিচ্ছি। অপারেশনের উপদেশ দিচ্ছি সেই বিশেষ বাহিনী ‘সোয়াত’-কে, যাদের এন্টি টেরোরিজম ট্রেইনিংয়ের প্রায় সবটাই হয়েছে উন্নত বিশ্বে, যেখানে আর যাই হোক বাড়তি পয়সা দিয়ে সনদ নেওয়ার চর্চাটা অন্তত নেই। কিংবা ভরপেট ডালপুরি-পিঁয়াজু খেয়ে মেলামাইনের গ্লাসে প্লাস্টিকের জগ থেকে পানি ঢালতে ঢালতে পরামর্শ আসে, ‘আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি ঢেলে সাজাতে হবে এবং তা এখনই’। ব্যাপারটা ‘না-সাধারণ’ উপদেষ্টাদের কাছে অনেকটা পানি ঢালার মতোই সহজ। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে?

রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক বিষয়ই শুধু কেন, ব্যক্তি জীবনেও পরামর্শের ঝড় বয়ে যায় স্যোশাল মিডিয়ায়। কেমন ছেলে বা মেয়ে ভালো, কোন এলাকার লোকের সমস্যা বেশি, কোন রাশির লোক ‘আলু’ সমস্যায় জর্জরিত, তার কি সেই ‘আলু’-র দোকান না কি রীতিমতো আলুর গুদাম আছে, নারীর পোশাক কেমন হওয়া উচিত, ছেলেদের কী কী কাজ করা অনুচিত, কোনটা করলে ক্যাবলা মনে হবে, কিভাবে বললে ছ্যাবলা মনে হবে, মুখ কেমনভাবে থুবিয়ে রাখলে ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পাবে—এসব উপদেশ হরহামেশা পাওয়া যায়। এমনকি, কোনওমতে জীবন পার করা লোকটাও ১০টাকার এমবি কিনে সবাইকে জানাচ্ছেন, কী কী কাজ করলে জীবনে সফল হওয়া যায়। আবার ৪২টা আইটেমের ভেতর ৪০টাই যখন ধ্বংস আর মৃত্যুর খবর, সেই নিউজ পড়ে আসার পর সংবাদ উপস্থাপকের জন্য পরামর্শ আসে, ‘আপনাকে আজ দেখলাম, আপনি আরেকটু হাসবেন প্লিজ, মুখ ভার করে থাকেন কেন?’ যদিও এ ধরনের উপদেষ্টাদের তারপরের লাইনেই জিজ্ঞাসা থাকে, ‘এত খবর মুখস্ত করেন কিভাবে, কখন থেকে পড়তে শুরু করেন? ম্যালা স্মরণশক্তি তো আপনার, অনেক ধৈর্যও লাগে তো!’

২.

আমরা কমবেশি সবাই যে যার জায়গায় ফ্যাশন সচেতন। এই যেমন হাল আমলের ডিজাইন থেকে শুরু করে বাবাদের যুগের প্যান্ট কাটিং দিব্যি চালিয়ে দিচ্ছি। মানাচ্ছেও। খারাপ না। শুধু ফ্যাশন কেন, আদতে আমরা বেশ সচেতন জাতি। ভোরে ঘুম ভাঙা থেকে মধ্যরাতে বালিশে নুইয়ে পড়া অবধি চেতনাবোধে জ্বলজ্বল করে আমাদের দুটি চোখ। কিন্তু হঠাৎ করে যদি কাল একটি প্যান্ট বানিয়ে আনি যার জিপার থাকবে পেছনের অংশে কিংবা দামি কাপড়ের শার্টের বোতামপ্লেট যদি পিঠের দিকটায় থাকে, তা নিজের কিংবা বাবার—যে আমলেরই হোক না কেন, কেমন লাগবে? শার্ট কম কাঁচুলি বেশি লাগবে, তাই না? আর প্যান্টের কথা নাই বা বললাম। ইন্টারনেট কিনে স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহারের বিষয়টাও তেমন। আমার এমবি, আমার গ্যাজেট, আমার মনে যা হচ্ছে, তাই ঠিক—এই ভাবনা থেকে সরে আসতে হবে।

লেবুটা ততক্ষণই চিবাতে হয়, যতক্ষণ এর অম্লরস গড়ায়। অতিরিক্ত কচলানোর চর্চা কখনোই ভালো কিছু বয়ে আনে না, আনে কেবল তিক্ততা। তা সে লেবুই হোক কিংবা স্যোশাল মিডিয়ায় ভাবের আদানপ্রদানই হোক। ভবিষ্যতের পথটা কি সৌভাগ্যে মিলবে নাকি দুর্ভাগ্যে, সে বিচার হয়তো ‘সময়’ করবে।

লেখক: সহযোগী বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন

sharfuddinanam@gmail.com