বাংলাদেশের স্বাস্থ্যচিত্র

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাপর পর দু’বার বেঁচে থাকা রোগীকে মৃত ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় চিকিৎসকরা। একটি ফরিদপুরে, আরেকটি ঘটেছে চট্টগামে। কিন্তু সমস্যাতো এখানেই নয়, অনেক গভীরে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যচিত্রটি কেমন? দূর মফস্বল নয়, রাজধানী ঢাকার যে কোনও সরকারি হাসপাতাল সফর করলেই তা বুঝা যায়। রোগীর তুলনায় শয্যার অপ্রতুলতা, চিকিৎসকদের অভাবতো আছেই। সমস্যা আছে হাসপাতাল প্রশাসনের সঙ্গে চিকিৎসক, রোগী ও রোগীর আত্মীয়দের সমন্বয়ের, যা মাঝেমধ্যেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শৃঙ্খলাহীনতা জানিয়ে দেয়। কিন্তু সব সমস্যাকে ছাপিয়ে সামনে এলো সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের অত্যাচার।
গত শনিবার সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফটকে এক অ্যাম্বুলেন্স চাপা দিয়ে মেরেছে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে, সাত বছরের এক শিশুকে, তার মাকে এবং এক বৃদ্ধ ভিক্ষুককে। কিন্তু ঘটনা এখানে থেমে নেই। দুর্ঘটনার সময় ওই অ্যাম্বুলেন্স যিনি চালাচ্ছিলেন, তিনি চালক নন, চালকের সহকারী। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ভাষ্য, ১৮ বছর বয়সী ওই তরুণ মোটরযানের ‘ব্রেক আর এক্সিলারেটরের মধ্যকার পার্থক্যই জানেন না’। ব্রেক কষতে গিয়ে তিনি এক্সিলারেটরের ওপর চাপ দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটাকে প্রাণঘাতী এক দানবে পরিণত করেছিলেন। এখন শুরু হয়েছে রোগী নিয়ে চরম নৈরাজ্য। অনেকদিন থেকেই খবর ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স সেবা নেই বললেই চলে, আর এই অনুপস্থিতির সুযোগে গড়ে উঠেছে এক সন্ত্রাসী ব্যবসা। হাসপাতালে কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের যোগশাজসে গড়ে উঠেছে এক ভয়ংকর নির্দয় অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা।
দেশের প্রধান ও সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এর নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স আছে মাত্র সাতটা। বার্ন ইউনিটের দুটো, বাকি পাঁচটা মূল হাসপাতালের। কিন্তু বার্ন ইউনিটের অ্যাম্বুলেন্স দুটো চলে না। কারণ, জ্বালানি বরাদ্দ নেই। মূল হাসপাতালের পাঁচটা অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে দুটো নষ্ট। এক শ্রেণির কর্মচারী ব্যক্তিমালিকানায় চালু করেছে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা। তাদের প্রায় শ’খানেক অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া বাইরের কোনও অ্যাম্বুলেন্স ওই হাসপাতালে ঢুকতে দেওয়া হয় না। সেই অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়াও আবার আকাশ ছোঁয়া। কিন্তু অসহায় রোগীদের কিছু করার থাকে না। অন্য বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালের সঙ্গে এদের চুক্তি আছে, রোগি এলেই সিট নেই বলে নিজেদের অ্যাম্বুলেন্সে রোগী পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেসব বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে।   

হাসপাতাল প্রশাসন আর চিকিৎসকের সামনেই এসব হচ্ছে। আমাদের প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে একই চিত্র। শুধু এই অ্যাম্বুলেন্স নৈরাজ্য নয়, হাসপাতালগুলোতে সুস্থ অবকাঠামো আর পরিবেশের অনুপস্থিতি। এক্স-রে, ইসিজি, ইইজি, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি রোগ নির্ণয়ের জরুরি যন্ত্রপাতি অধিকাংশ হাসপাতালেই অকেজো থাকে, যার ফলে রোগীদের বাইরে থেকে এসব পরীক্ষা করিয়ে আনতে হয়। কিন্তু সিরিঞ্জ, সুচ, স্পিরিট বা গজ-তুলার মতো সামান্য উপকরণগুলোও প্রায়ই সরকারি হাসপাতালে মজুত থাকে না।

সেবার সংকট আস্থার সংকটকে এতো তীব্র করেছে যে, প্রায়ই বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের হাতে চিকিৎসকরা নিগৃহীত হচ্ছেন। আর এর প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করেন চিকিৎসকরা। স্বজনরা মারমুখী হন, কারণ, তারা চিকিৎসকদের ভরসায় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু চিকিৎসকদের সেবা পছন্দ না হলেই তাদের ওপর চড়াও হচ্ছেন। প্রশ্ন হলো শুধু চিকিৎসকদের ওপরই কি সব নির্ভর করে? তারা কী দিয়ে চিকিৎসা করবেন, যদি তাদের কাছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা-সামগ্রী মজুত না থাকে?  যদি হাসপাতালের বেডের চেয়ে রোগী অনেক বেশি হয়? যদি চরম অব্যবস্থা আর নৈরাজ্যই স্বাভাবিক হয়ে থাকে? রাজধানী সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা যখন ভালো নয়, তখন জেলা, উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর অবস্থা কী রূপ, কল্পনা করতেও ভয় লাগে। একদিকে সরঞ্জামের অভাব, অন্যদিকে মাসের পর মাস চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ক্রমেই সাধারণের নাগালের বাইরে নিয়ে গেছে।

তবে একথাও ঠিক যে, বর্তমানে বেশ কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভালো বাড়ি হয়েছে, বেশ কিছু উন্নত যন্ত্রপাতি বসেছে, কিন্তু এ সব যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, অর্থাৎ রোগীর চিকিৎসা করা সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতে যে আন্তরিকতা দরকার তা নেই। শুধু যন্ত্র সব কাজ করতে পারে না। রাজধানীর বাইরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ডাক্তারদের হাজিরার করুণ চিত্র এবং রোগী দেখার আন্তরিকতার অভাব সবাই জানে। চিকিৎসা না পেয়ে গ্রামের রোগী শহরের হাসপাতালগুলোয় চাপ তৈরি করছে।

অনেক সমস্যা নিয়ে কাজ করেন চিকিৎসকরা, একথা সত্যি। তবে এটাও সত্যি যে সরকারি চাকরিটা এখন অনেক ডাক্তারে কাছে নিশ্চিত ভালো মাইনের আয় আর প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে রোগী টানার যোগাযোগের মাধ্যম মাত্র। রাজনীতি করে ভালো পদ বাগিয়ে নেয়া মাত্র। অন্য শ্রেণির কর্মীর কাছেও বর্তমানের নিশ্চিত আয় আর সাথে কমিশন ব্যবসা বা অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার মতো কত কী বাণিজ্য।

উপরে অনেকগুলো যদির কথা উঠেছে। প্রশ্ন হলো যদি মানসিকতা না গড়ে ওঠে, তা হলে যতই হাসপাতাল, সরঞ্জাম, ডাক্তার সরকারি ব্যবস্থায় বাড়ানো হোক না কেন, তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম। সরকারি ব্যবস্থা যতই দুর্বল হচ্ছে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে ক্রমশ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চলে যাচ্ছে। এবং তার পরিণতি হলো আনাচে কানাচে ক্লিনিক আর ডায়গনস্টিক ব্যবসা, যেখানে সেখানে যেমন তেমন হাসপাতাল আর সাধারণ মানুষের টাকার শ্রাদ্ধ। করপোরেট হাসপাতাল বা প্রাইভেট প্র্যাক্টিসেও নৈরাজ্যের আওয়াজ পাওয়া যায়। এতে করে চিকিৎসার মতো মহান পেশার মহত্ত্ব আজ প্রশ্নের মুখে।

এসব কি চলতেই থাকবে? স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা নিয়ে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু সমস্যাতো কেবল অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসাতে নয়। চিকিৎসাপ্রার্থী রোগীদের ন্যূনতম সেবা দেওয়ার বন্দোবস্ত কবে হবে এই দেশে? স্বাস্থ্য-প্রশাসনের তরফে একটু দায়বদ্ধতা, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে একটু সদিচ্ছা, চিকিৎসাপ্রার্থী অসহায় রোগীদের প্রতি মানবিকতা ও সহানুভূতির একটু তাগিদ দেখবার আশায় বাঙালি অপেক্ষা করছে স্বাধীনতার পর থেকে।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি