২০১১ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভী ছিলেন মিডিয়া ও দেশবাসীর অন্যরকম পাদপ্রদীপের আলোয়। একঅর্থে তিনি তখন ছিলেন সুশীল সমাজের প্রার্থী। প্রবল পরাক্রমশালী শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তিনি মিডিয়া ও দেশবাসীর নজর কাড়েন। ওই নির্বাচনে বিএনপি চেয়েছিল শামীম ওসমানের পরাজয়। তাই শেষ মুহূর্তে বিএনপি প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারের আপত্তির পরও দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে তাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। সেই ঘটনা মনে রেখেছেন তৈমুর আলম খন্দকার। তাই এবারের নির্বাচনে দলের হাইকমান্ডের আগ্রহকে উপেক্ষা করে নির্বাচনে প্রার্থী হননি তিনি। সেটাই সুযোগ এনে দেয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবারের বিএনপি দলীয় প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনকে। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৭জন প্রার্থীর মধ্যে এবার সাখাওয়াতই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী সেলিনা হায়াৎ আইভীর।
দুই.
এবারের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করার আগে গতবারের নির্বাচনি ফলের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ৪ লাখ ভোটারের মধ্যে গতবারের নির্বাচনে দোয়াতকলম প্রতীকে সেলিনা হায়াৎ আইভী পেয়েছিলেন ১লাখ ৮০ হাজার ভোট। যা কাস্টিং ভোটের প্রায় ৬৫ শতাংশ। অন্যদিকে দেয়ালঘড়ি প্রতীক নিয়ে শামীম ওসমান পেয়েছিলেন ৭৮ হাজারের ওপর কিছু ভোট যা কাস্টিং ভোটের ২৮ শতাংশ। আনারস প্রতীক নিয়ে তৈমুর আলম খন্দকার সেবার পান ৭ হাজার ৬০০ ভোট। যা কাস্টিং ভোটের ৪ শতাংশ। এই ফল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, সেলিনা হায়াৎ আইভী সেবার দলমত নির্বিশেষে অনেকের ভোট পেয়েছিলেন। দলীয় ভোটের বাইরে তার পাওয়া ভোটের বড় অংশ এসেছিল নির্দলীয় ভোটার, শামীম ওসমানবিরোধী ভোটারসহ অন্যান্য দলীয় ভোটারদের কাছ থেকে। সেবার সেলিনা হায়াৎ আইভী মারাত্মক সুরক্ষা পেয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে। সুশীল সমাজ, মিডিয়াও তাকে দিয়েছিল একতরফা সমর্থন। সে কারণে সেলিনা হায়াত আইভীবিরোধী শামীম ওসমানের সব ধরনের আক্রমণ কৌশল ভেস্তে যায় সরবেই।
তিন.
কিন্তু এবারের নির্বাচনে কি সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে সেসব হিসাব কাজ করবে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখা দরকার, এবারের নির্বাচন কেমন হবে? যেকোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে মানুষ দেখে সেই বিষয়ে তার সাম্প্রতিক অতীতের অভিজ্ঞতা কী। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আওতায় যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতার ওপর ভর করলে বলা যায়, সরকারি ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার কোনও ক্ষমতা এই নির্বাচন কমিশনের নেই। সরকার প্রশাসনিক শক্তি দিয়ে প্রকাশ্য বা গোপনে এই নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চাইলে তা ঠেকানোর ইচ্ছা বা ক্ষমতা কোনোটাই এই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে দেখানো সম্ভব নয়। সেই বিবেচনায় বলা যায়, সরকার যদি চায় একটা ফেয়ার নির্বাচন, তাহলেই কেবল এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য মানের হতে পারে। সে হিসেবে সেলিনা হায়াৎ আইভীর যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে জনসমাজে, সেখানে একটি বিতর্কিত, প্রশাসনপ্রভাবিত, নির্বাচন কমিশনের নিস্পৃহতার মধ্যে দিয়ে সংগঠিত নির্বাচন তাতে কালিমা দেবে। নির্বাচনে জেতা বা হারার চেয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভীর ব্যতিক্রমী ‘স্বচ্ছ-সুজন’ইমেজটা এবারের নির্বাচনে টিকবে কিনা, সেটাও তার জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ।
চার.
সেলিনা হায়াৎ আইভীর জন্য বড় ব্যারিয়ার শামীম ওসমান। সরকার প্রধানের আপাতত ইচ্ছের কাছে নতি স্বীকার করেছেন স্থানীয় এ সংসদ সদস্য। আইভীর বিপক্ষে তার প্রকাশ্য তৎপরতা নেই। কিন্তু শামীম ওসমান যদি আইভীর পক্ষেই মাঠে নামেন, তাহলে সেটা কি আইভীকে ভোটাররা কাছে টানবে? যে আইভীর লড়াকু ইমেজ গড়ে উঠেছে শামীম ওসমানের কথিত সব শক্তিমান বিরুদ্ধতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, সেই শামীম ওসমানকে শুধু দলের প্রতীকের সুরে পাশে টানলে মানুষ কি আইভীকে সেই সম্মান করবে? আবার শক্তিমান শামীম ওসমান যদি গোপনে বিরোধিতা করে সেই বিরোধিতা কি এবার সামলাতে পারবেন সেলিনা হায়াৎ আইভী? নির্বাচনের দিন আইভীর নামেই তার শত্রুপক্ষ ভোটকেন্দ্র দখল করে এই নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে চাইলে, সেটাই বা সামলাবেন কি করে আইভী?
পাঁচ.
এবারের নির্বাচন হচ্ছে দলীয় প্রতীকে। বিভাজিত রাজনৈতিক এই উত্তাপের দিনে নির্ভয়ে ভোট দিতে যেতে পারলে দলীয় সমর্থকরা ব্যক্তির চাইতে দলীয় প্রতীকেই আস্থা রাখবেন বেশি। সুতরাং রাজনৈতিক সচেতন অংশের ভোট পড়বে নিজ নিজ পছন্দের দলের প্রতীকে। সে হিসেবে গত নির্বাচনের তুলনায় এবারের নির্বাচন আইভীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। জামায়াতের ভোট, হেফাজতের ভোট, বিএনপির ভোট আইভীর বাক্সে আসা বড় কঠিন এবার। সেলিনা হায়াৎ আইভী যত ভালো ইমেজের মানুষই হন না কেন , গত পাঁচ বছর মেয়র হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন। তার যোগ্যতা আর দুর্নীতিহীনতা কম শত্রু তৈরি করেছে, এ কথা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা কঠিন। অন্যদিকে সেলিনা হায়াৎ আইভীর ব্যক্তি ইমেজ যাই হোক না কেন, সরকারের বিরুদ্ধবাদী যারা, যারা এই সরকারের নানাকাজে ক্ষুব্ধ, সেই প্রতিবাদী ভোটও এবার ছেড়ে যেতে পারে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে।
ছয়.
আইভীর প্রতিদ্বন্দ্বী ভোটের রাজনীতিতে নতুন হলেও তার ফেয়ার ইমেজ, তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকা, এসব বরং তাকে বড় লিফট দিতে পারে। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন নারায়ণগঞ্জে দলের সবচেয়ে ভালো প্রার্থী। তৈমুর আলম খন্দকারের চেয়েও তিনি শক্তিমান প্রার্থী। এই নির্বাচনে ক্ষতি যদি কারও হয়ে থাকে, সেটা হয়েছে তৈমুর আলম খন্দকারের। রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা ও অভিমান যে রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কত বড় ধস আনে, এটা এবার টের পেতে পারেন বিএনপির এই নেতা। কারণ জিতুক বা হারুক ফল যাই হোক না কেন অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন যে প্রচার পাচ্ছেন মিডিয়ার কল্যাণে, গোটা দল তার পক্ষে যেভাবে নির্বাচনি মাঠে দাঁড়াচ্ছে, তাতে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির একটা স্থায়ী সম্পদে পরিণত হলেন তিনি। এই পরিচয় ও প্রচারণা ভবিষ্যতে নারায়ণগঞ্জ বিএনপিতে তাকে বড় আসন দেবে। জিতলে তো কথাই নেই, হারলেও অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনের হারানোর কিছু থাকবে না।
সাত.
যেকোনও নির্বাচনে অনেক ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ থাকে। এবারের নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও সেটা থাকছে। যদি ভালো নির্বাচন হয় , যদি প্রশাসন পক্ষপাত দুষ্ট আচরণ না করে, যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনের মাঠে থাকে, তবে একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। সেলিনা হায়াৎ আইভী লড়াকু মানুষ। নারায়ণগঞ্জে যে পুরুষতান্ত্রিকতা , যে অসম শক্তির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লড়াই করে তিনি আমজনতার ভালোবাসা পেয়েছেন, তা কম বড় কথা নয়। তবে এবার তাকে লড়তে হচ্ছে দলীয় প্রতীক নিয়ে। দলীয় প্রতীকের সুবিধা যেমন আছে , তেমনি দলীয় প্রতীকের সরব ও নীরব বিরোধিতাও আছে। সেটার দায় এবার নিতে হচ্ছে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে। তিনি এবার নির্বাচনি মাঠে উৎরে গেলে নারায়ণগঞ্জ রাজনীতির তিনিই বড় শক্তি হয়ে উঠবেন। একজন নারীর এই উত্থান কি মেনে নেবে নিজ দল ও অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের শক্তিমান পুরুষ এস্টাবলিশমেন্ট? সেটাও তার জন্য এক বড় লড়াই।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।