প্রশ্নটি যখন জীবন-মৃত্যুর

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজারাজধানী ঢাকার এক ভয়ঙ্কর দুর্নাম যখন-তখন আগুন লাগা। ভয়াবহ সব আগুন। এই শহর বড় মেট্রোপলিটন সিটি। এই এলাকার স্থাপনাগুলো খড়ের চালের কুঁড়েঘর নয়। বস্তিতে যেমন লাগছে, লাগছে বড় অট্টালিকায়, আধুনিক শপিংমল ও অভিজাত পাড়াতেও।
গুলশান ডিসিসি মার্কেটের আগুন নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, সেসবে যেতে চাই না। আগুন নির্বাপিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষ আছে অনেক, কর্তা আছেন। তারা কথা বলবেন অনেক। জনগণের ক্ষোভ আর কয়েকদিন পরেই প্রশমিত হয়ে যাবে, নতুন কোনও বিপর্যয় বা উৎসব এসে গুলশানের বেদনাকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে।
কড়াইল বস্তির পর গুলশানে আগুন লাগে। কতজন পুড়ে যায়, কত সম্পদ ছাই হয়ে যায়, কিন্তু একের পর এক আগুন যাকে কখনোই দগ্ধ করতে পারে না, তা হলো দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।
আগুন কেন লাগে? ইচ্ছাকৃত অনেক আগুন লাগে, যেমনটা গুলশানের আগুনের বেলায় বলা হলো। কিন্তু আমরা জানি, এই শহরে অগ্নিনিরাপত্তা বিধি বলে কিছু নেই। বহু বিদেশি শহর আর নগরের নাম উচ্চারিত হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মান থেকে আলোকবর্ষ দূরে।
ঢাকা কেবলই আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। কত সুরম্য ভবন। কিন্তু আগুন থেকে বাঁচার জন্য এসব ভবনে নেই কোনও ব্যবস্থা, নেই কোনও সুনির্দিষ্ট বিধি বা আইন। আগুন লেগে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে আনার সক্ষমতাও বাড়ছে না সেই গতিতে, যে গতিতে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বাড়ছে।
আইন চাই, এটা কোনও বিলাসিতা নয়। মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন। বিধির ফাঁক গলে যখন একের পর এক আগুনের ঘটনা ঘটে, তখন বোঝা যায়, উচ্চমানের অগ্নি-নিরাপত্তা মানুষের জন্য অনেক বেশি জরুরি।
আন্তর্জাতিক মানের বিধি তৈরি হলেও যতক্ষণ প্রশাসন তা প্রয়োগ করতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা না করবে, ততক্ষণ সব বিধিই অসার। পরিদর্শক দলের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেই আর নিয়ম মানার দায় থাকে না; এই অভিজ্ঞতা সর্বস্তরের। পরিদর্শন করার পর দোষ পায়নি, কিন্তু পরে আগুন লেগেছে এমন ঘটনা অসংখ্য।
আমাদের বোধোদয় হোক। শহরের সব বহুতলে, সব প্রতিষ্ঠানে কঠোরভাবে অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ম যেন যথার্থভাবে প্রযুক্ত হয়, তা নিশ্চিত করা প্রশাসনের দায়িত্ব। যারা নিয়ম মানবে না, তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে ব্যবসার অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। প্রশ্নটি যখন জীবন-মৃত্যুর, তখন ন্যূনতম বিচ্যুতিও সহ্য করা চলে না।
গুলশানে, কড়াইলে উত্তরের মেয়র ছিলেন। নিজে আগুন নেভানোর প্রচেষ্টা তদারকি করেছেন। কিন্তু মেয়রের সীমাবদ্ধতা আমরা জানি। সরকারের বহু সংস্থা তার কথা শুনে না। তাই তার একার উদ্যোগ কোনও কাজে আসবে না।
সিটি করপোরেশন হতে ফায়ার সার্ভিস, সবাই যেন সাযুজ্য বজায় রেখে শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্রিয় হয়, তা দেখার সময় এখন। দায়িত্ব সরকারের। তাই আশা করছি প্রধানমন্ত্রী নিজে নজর দেবেন। নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব আছে। প্রশাসন তার দায়িত্ব পালন করবে, কিন্তু আমরাও কেবল বিল্ডিং বানিয়েই যাবো, নিরাপত্তায় উদাসীন থাকব, তা হতে পারে না।
গণমাধ্যমেরও নজরদারি বাড়ানো দরকার। প্রশাসনিক গাফিলতি দেখলে সরব হতে হবে। আর কোনও প্রাণ যেন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার আগুনে দগ্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করতেই হবে আমাদের।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি