সামরিক চুক্তি আত্মঘাতী হবে

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীদেহের মাংসে হরিণী বৈরী। এ কথাটার মতো হচ্ছে বাংলাদেশের অবস্থান। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এমন এক জায়গায় তার অবস্থান তাতে তার স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে খুবই বেশি। এখন সবাই চায় বাংলাদেশের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে। বাংলাদেশের লাগোয়া দেশ হচ্ছে চীন ও ভারত। উভয়ে বৃহত্তর দেশ। অ্যাটোমিক ক্লাবের মেম্বার। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তিন দিকেই স্থল সীমান্ত আর জলসীমানাও ভারতের সঙ্গে রয়েছে। ভারতের সঙ্গে অনুরূপ অবস্থানের কারণে অন্যদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক পড়তে গেলে সে দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা তলিয়ে দেখতে হয়।
ক’দিন আগে চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তিনি বাংলাদেশ সফর করেছেন তার দেশের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে। স্টেট কাউন্সিলর, বাণিজ্য মন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। চীনের প্রেসিডেন্ট এ সফরের আগের দিন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ১০০ কর্মকর্তা ও বাংলাদেশে আগমন করেছিলেন। উভয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুচুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। শুধু ২৬টি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে চীনের প্রেসিডেন্ট-এর সফর সঙ্গীদের সঙ্গে।
চীনের প্রেসিডেন্ট ও শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পাবে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের রিজার্ভের চেয়েও বেশি। চীনের প্রেসিডেন্ট বলেছেন চীন বাংলাদেশকে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে পেতে চায়। স্ট্র্যাটেজিক শব্দটা কিন্তু সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয় বেশি। বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতিতে তার ভূমিকা নির্ধারণে কঠিন অবস্থানে পড়বে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও গত বছর এসেছিলেন। তিনিও বাংলাদেশের সঙ্গে সীমানা চুক্তি চূড়ান্ত করে গেছেন এবং ৪২ বছর আগে সম্পাদিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি শতাংশে বাস্তবায়ন করেছেন। অবশ্য তিস্তা পানি বণ্টনের বিষয়টা পশ্চিম বাংলার মূখ্যমন্ত্রী মমতার কারণে কিছু করতে পারেননি।

আমরা লক্ষ্য করেছি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার সফরের সময় যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন। অবশ্য একটা কথা উল্লেখ করতেই হয়, ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়নের বিলম্বের কারণও ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি। গঙ্গার পানি বণ্টনের বিষয়টা নিয়েও ভারত অহেতুক টালবাহানা করেছিলো। পরবর্তী সময়ে চুক্তি করেছে চমৎকারভাবে। পানির যথাযথ অংশ বাংলাদেশে পাক বা না পাক কিন্তু চুক্তির বয়ান হচ্ছে গ্রীষ্ম মৌসুমে গঙ্গার পানি সমানভাবে ভাগ করে নেব। বয়ান ছিল খুবই ন্যায় নিষ্ঠতা ভিত্তিক।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ চীন থেকে দু’টি সাবমেরিন ক্রয় করেছে এবং চীন সাবমেরিন দু’টির ডেলিভারির কাজও সম্পন্ন করেছে। সাবমেরিন দু’টি এখন বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর হেফাজতে রয়েছে। আমরা একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর এবং সাবমেরিন ক্রয়ের বিষয় নিয়ে ভারত সম্ভবতো বিচলিত হয়েছে। ভারতের গণমাধ্যম এমনও কথা বলেছে যে বাংলাদেশের সাবমেরিনের প্রয়োজন হলো কেন? বাংলাদেশ কার সঙ্গে যুদ্ধ করবে?

স্থল সীমান্ত রক্ষার জন্য আমাদের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, নিয়মিত সামরিক বাহিনী যদি প্রয়োজন হয় এবং যদি আমরা গড়ে তুলতে পারি ট্যাংক বাহিনী, যদি আমাদের থাকতে পারে বিমানবাহিনী, তবে আমাদের নৌ-বাহিনীর সাবমেরিন থাকাটা দোষের হবে কেন তা বুঝা মুশকিল। আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক ধার্যকৃত বাংলাদেশের জলভাগের এরিয়া হলো ১ লক্ষ ১৮ হাজার বর্গ কিলোটিার অর্থাৎ আরেকটা বাংলাদেশ। জলভাগে বাংলাদেশ তার ব্লু-ইকোনমির কাজ আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই মাঝে গ্যাস ব্লকে গ্যাস-অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য বিদেশি ফার্ম নিয়োগ করা হচ্ছে সুতরাং আমাদের সীমান্তে তো আমাদের নিজস্ব এবং আমাদের দেশে থাকা বিদেশিদের নিরাপত্তা দিতে হবে। এ কাজের জন্য দু’টি সাবমেরিন বাংলাদেশের ন্যূনতম প্রয়োজন।

ভারতের দেশরক্ষা মন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তিনি তার দেশের তিনবাহিনীর উপ-প্রধানদেরকেও সঙ্গে এনেছিলেন। বাংলাদেশের বাহিনী প্রধানদের সঙ্গে দেশরক্ষামন্ত্রী দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করে গেছেন এবং ভারত সরকার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় কিছু চুক্তির খসড়া প্রস্তুত নাকি করেছেন। তিনি গেলে হয়ত সে সব চুক্তি স্বাক্ষর করতেন। কিন্তু তিনি নির্ধারিত সময়ে সফর না করে সফর পিছিয়েছেন। আমরা এর মাঝে গণমাধ্যমে দেখেছি যে খসড়া চুক্তিগুলোর মাঝে সামরিক চুক্তির একটি খসড়াও নাকি রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ সামরিক চুক্তির কথা শুনে উদ্বিগ্ন হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সামরিক চুক্তির প্রয়োজন হলো কেন?

পাকিস্তানি সন্ত্রাসীরা যখন বারবার ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে পাঠানকোট আর উরী সেনাছাউনি আক্রমণ করেছিলো এবং তার উত্তরে ভারত যখন পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছে তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে রয়েছে। বাংলাদেশের নৈতিক সমর্থন ছাড়া আর কী বা করার রয়েছে। বাংলাদেশ ভারত ও চীনের সীমান্তের দেশ। বাংলাদেশ থেকে চীনের মাত্র ৬০ মাইল দূরত্বে অবস্থান।

ভারত ও চীন বৈরী দেশ। বাংলাদেশ বাফার স্টেটের মতো অবস্থানে রয়েছে। এমন অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ কারও সঙ্গে সামরিক চুক্তি সম্পাদন করতে পারে না। সুতরাং আমরা আশা করবো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত সফরের সময় এমন কোনও সামরিক চুক্তি সম্পাদনের বিষয় এড়িয়ে যাবেন। ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করলে প্রধানমন্ত্রীকে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। আগামী দু’বছর পরেই সাধারণ নির্বাচন।

রাশিয়াও এর মাঝে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। তারা ৭১ সালের মতো নিবীড় সম্পর্কে স্থাপনে আগ্রহী। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনও নাকি বাংলাদেশ সফরে আগ্রহী। রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলাপ-আলোচনা করে সুবিধাজনক সময় নির্ধারণের চেষ্টা করছেন। রাশিয়া চাইছে ‘ইন্টারগর্ভমেন্টাল কমিশন অব স্টেট ইকোনোমিক অ্যান্ড সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কোপারেশন বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড রাশিয়া’ এমন একটা চুক্তি করে উভয় দেশের সম্পর্কে ব্যাপক ভিত্তিক করতে ইচ্ছে প্রকাশ করছেন।

ব্লু- ইকোনমির ব্যাপারেও তারা বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। রাশিয়া, আমেরিকা, চীন ভারতই হচ্ছে এখন পৃথিবীর বড়শক্তি। চীন আর ভারত হচ্ছে বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী। আবার উভয় দেশের বৈরীতা উল্লেখযোগ্যভাবে তীব্র। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের উপস্থিতিকে আমেরিকা মেনে নিচ্ছে না। এ নিয়ে উভয় রাষ্ট্র উত্তেজনাকর কথাবার্তা বলছে।

২০ জানুয়ারি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট শপথ গ্রহণের পর উভয় রাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। এমন পরিস্থিতি আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সহায়ক শক্তি হিসেবে উপস্থিতি অকল্পনীয় নয়। সুতরাং ক্ষুদ্রদেশ হিসেবে বাংলাদেশে কোনও পক্ষে ঝুঁকে না পড়াই হবে উত্তম। সুতরাং দক্ষিণ এশিয়ায় যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে কারও সঙ্গে কোনও সামরিক চুক্তি হবে বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক খারাপ।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন মধুর। কিন্তু এটাও ভুলে গেলে চলবে না প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের আচরণের ইতিহাস কখনও সন্তোষজনক নয়। নেপালকে তারা বার বার অবরোধের মাঝে ফেলতে দ্বিধা করেনি। অথচ স্থলপরিবেষ্টিত এ দেশটার জন্য অবরোধ ভয়াবহ পরিণতি ভয়ে আনে।

‘ফ্রান্সের স্বার্থ এবং ফ্রান্সই শেষ কথা’- এমন নেপোলিন আচরণ ভারত করতে অব্যস্ত এবং নেপালের সঙ্গে বারবার তাই তারা করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গেও যে অনুরূপ আচরণ করবে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং বাংলাদেশের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন গভীর বিবেচনা প্রসূত হয়। বাংলাদেশ কারও পক্ষে বা বিরুদ্ধে ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হবে না বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়টার প্রতি স্থিরপ্রতিজ্ঞ থাকতে হবে। সামরিক চুক্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেয়ে নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলে বেশি- বাংলাদেশকে এ কথাটা মনে রাখতে হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com