‘বাঘে ধরলে ছাড়ে, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না’- বলবে কে আর!

চিররঞ্জন সরকারআমাদের দেশের রাজনীতিতে রাজনীতিবিদের বড় আকাল। ভুঁইফোড় নয়, মাটি থেকে উঠে আসা মাটির মানুষের রাজনীতিবিদ। যারা ত্যাগ-তিতিক্ষা আর অধ্যাবসায়ের সিঁড়ি বেয়ে রাজনীতির শীর্ষ গন্তব্যে পৌঁছেছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন তেমন একজন আলো-ঝলমল আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ। যার ধ্যানজ্ঞান ছিল রাজনীতি, মানুষ, দেশ। তাঁর মহাপ্রয়াণ আমাদের রাজনীতির মঞ্চটাকেই যেন অন্ধকার করে দিয়ে গেলো! সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক শোকবার্তায় বলেছেন, ‘তার মৃত্যুতে জাতি হারালো একজন দেশ প্রেমিক রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ হারালো একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, আর আমরা হারালাম সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের একজন অগ্র সেনানীকে।’ সেনগুপ্তের প্রয়াণ-অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে এই বাক্যটিই সবেচেয়ে লাগসই ও যথার্থ।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাস্তববাদী ছিলেন। কিছুটা জেদিও ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে কঠিনতম সময়েও কাউকে পাত্তা দিয়ে চলেননি। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি বঙ্গবন্ধুকে পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে প্রতাপশালী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে ‘না’ বলেছিলেন। দুর্দান্ত সাহস দেখিয়ে তিনি দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অর্জন করেছেন অনেক সম্মান ও খ্যাতি। মোট সাতবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর মধ্যে ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে চারবার আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ১৯৭০ সালে ন্যাপ থেকে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে একতা পার্টি ও ১৯৭৯ সালে গণতন্ত্রী পার্টি থেকে এমপি হন। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও পরে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে আসেন তিনি।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর রাজনৈতিক জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। রাজনীতির প্রথম জীবনে বামপন্থী ছাত্ররাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে ন্যাপ থেকে নির্বাচন করে প্রথম এমপি হন। ওই নির্বাচনে প্রায় সব আসনে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের নেতারা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেই সময়ের তরুণ এমপি সুরঞ্জিত সবার মনোযোগ কাড়েন। আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার আগে তিনি রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পরিচিত পান ‘ছোট দলের বড় নেতা’ হিসেবে। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। তা ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনী আনতে গঠিত কমিটির কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
ষাটের দশকে ছাত্ররাজনীতি দিয়ে সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের সক্রিয় রাজনীতির শুরু। আইয়ুব-মোনায়েম বিরোধী উত্তাল আন্দোলনে ছিলেন সামনের সারিতে। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজপথ কাঁপিয়েছেন। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয় তার। এগার দফা, ছয় দফা আন্দোলন, সত্তরে ন্যাশনাল আসেম্বলির সদস্য, সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনি।
আপাদমস্তক রাজনীতিক হিসেবে সেক্যুলার কিংবা অসাম্প্রদায়িক চিন্তা, চেতনা ধারণ করেছেন সবসময়ই। বর্ণিল রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ৫৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রথম সারির রাজনীতিকের আসনে আসীন থেকেছেন আমৃত্যু। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে সংসদ-বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দলে ‘সংস্কারপন্থী’ নেতা বলে পরিচিত হন তিনি। এ কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর তাঁকে মন্ত্রী করা হয়নি। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও বাদ পড়েন তিনি। পরে ২০১২ সালে রেলমন্ত্রী হলেও তাঁর সহকারীর গাড়িতে বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েন সুরঞ্জিত। তবে শেষ পর্যন্ত এপিএসের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে অবশেষে পদত্যাগ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে তার মন্ত্রীসভায় রেখে দেন।

এ ঘটনার পেছনে কোনও ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা বা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নেপথ্যে কোনও ঘটনা রয়েছে কিনা, এ প্রশ্নটি সেসময় অনেকেই করেছেন। কিন্তু উত্তর মেলেনি। এপিএস’র অর্থ কেলেঙ্কারীর ঘটনা তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সুরঞ্জিত সেনকে নির্দোষ ঘোষণা করলে আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলন তিনি পুনরায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত হন।

সারাজীবন দাপট দেখিয়ে চলা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্বটা খুব একটা মধুর হয়নি। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকারের আমলে কথিত ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার ফাঁদে তিনিও পা দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়।অনেকের মতেই যা ছিল তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বড় ভুল। আবার এমনটাও বলা হয় যে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত র‌্যাটস্‌ (RATS)-এর একজন। ওয়ান ইলাভেনের সময় আওয়ামী লীগ নেতা রাজ্জাক, আমু, তোফায়েল ও সুরঞ্জিত সংস্কারবাদী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তাদের সেনাবাহিনীর চর বলে মনে করা হত। এদের নামের অদ্যাক্ষর থেকে তৈরি হয় RATS বা র‌্যাটস। আওয়ামী লীগে তারা হলেন, ‘বিশ্বাসভঙ্গকারী’। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই কথিত সংস্কারবাদীরা নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছে। সংবিধান সংশোধন কমিটিতে কাজ করে সুরঞ্জিত প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসতে পেরেছেন। মন্ত্রী হয়েছেন।  কিন্তু অনেকে সে সময় পিছিয়ে পড়েছেন। তাঁর এপিএসের অর্থকেলেঙ্কারির ঘটনা সেই পিছিয়ে-পড়াদের সম্মিলিত ‘ষড়যন্ত্রের ফল’ বলেই অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন। তিনি নিজেও তাঁর এই পরিণতির পেছনে ‘গভীর ষড়যন্ত্র’ ছিল বলে জানিয়েছেন। এই ঘটনার পর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে ‘কালো বিড়াল’ নামে অভিহিত করা হয়। আমৃত্যু সেই কলংকের বোঝা বয়ে চলতে হয় প্রবীন এই রাজনীতিককে।

দলে চাপে থাকা এই নেতা একটি আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ‘বাঘে ধরলে ছাড়ে, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না।’  না, এবার শুধু শেখ হাসিনা নয়, সবার, সব রকম ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। পরিণত, সত্তরোর্ধ বয়সে চলে গেলেন এই সংগ্রামী রাজনীতিবিদ।। যেকোনও স্তরের মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর সহজাত। এই গুণটির কারণে তিনি অসংখ্য মানুষকে আপন করে নিতে পেরেছিলেন। এমনকী প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের সাথেও তার স্বাভাবিক কথা-বার্তার সম্পর্ক কখনও ছিন্ন হয়েছে বলে শোনা যায়নি। সাংবাদিকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল সুমধুর ও অন্তরঙ্গ। 

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুধু একজন রাজনীতিকই ছিলেন না, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নেও তিনি অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। সংসদীয় রাজনীতিতে তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। জনগণের অংশগ্রহণমূলক প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র সমুজ্জ্বল রাখা এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা চালু রাখার লক্ষ্যে আজীবন কাজ করে গেছেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও অন্তত এই একটি কারণে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকবেন, তার অপর সকল দোষগুণ ছাপিয়ে।

মৃত্যুর একটা জাদু আছে। মৃত্যুর পটে ব্যক্তির ছবি হঠাৎ কেমন পালটে যায়। জীবনে যাকে নিয়ে কঠোর বিতর্কের ঝড় উঠেছে, মৃত্যুর পর শত্রুমিত্র সবাই তাকে দেখেছে অন্য এক স্নিগ্ধ আলোতে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের একটা গুঢ় রহস্য মৃত্যু অনাবৃত করে। যে মানুষটা বেঁচে ছিল সে সঙ্গী, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে। সংসারে যে সব সম্পদ পরিমাণে সীমাবদ্ধ, যেমন খাদ্য অথবা অর্থ, সেসব তো একজন বেশি পেলে অন্যের জন্য অবশিষ্ট থাকে কম। অনটনের বস্তুর ওপর যে ভাগ বসায় সেই আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। দ্বন্দ্ব শুধু অর্থের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়েই নয়, ক্ষমতা নিয়ে পদাধিকার নিয়ে। এমনকি সুনাম নিয়েও। জীবিত মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভেতর এসে পড়ে এই সাংসারিক দ্বন্দ্বের জটিলতা, ঈর্ষা লোভ কুটিল চক্রান্ত।

কিন্তু মানুষটি যখন চলে গেল, তার সঙ্গে তখন আর আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রইল না। একদিন যে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আজ সে নেই। দেহমুক্ত স্মৃতির সঙ্গে আমাদের বিবাদের সাংসারিক কারণ নেই। তাইতো যে মানুষটিকে নিয়ে জীবনে আমাদের অভিযোগের অন্ত ছিল না, মৃত্যুর পর তার জন্যই অশ্রুপাত করি। মৃত্যুর কাছে তাই কবির প্রার্থনা: ‘‘যা কিছু মলিন, যা-কিছু কালো, যা-কিছু বিরূপ হোক তা ভালো-ঘুচাও ঘুচাও সব আবরণ!’’

মুত্যুর শাসন থেকে কিছুই মুক্ত নয়, নির্মোহ এই জানাতেই রয়েছে মুক্তি। মৃত্যুকে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে প্রণাম জানিয়ে তাই আমরা জীবনের পথে চলি, অসংখ্য মৃত্যুকে অতিক্রম করে যে জীবন এগিয়ে চলেছে!

লেখক: কলামিস্ট