দিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাগুলো দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ভয়ানক পীড়া দিয়ে চলেছে। অনেকে তো প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াকে জাতির ‘শিক্ষার গলায় ফাঁস’ হিসেবেও চিহ্নিত করছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমানে চলছে সীমাহীন নৈরাজ্য। মাত্র কিছুদিন আগে সাম্প্রদায়িকীকরণ ও ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজটি দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন হওয়ার ঘটনাটিও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ভয়ানক ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। শিক্ষা নিয়ে এমন হেলাফেলা আর ছেলেখেলা দেখে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই গভীর শঙ্কা প্রকাশ করছেন। দেশকে, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে ডুবিয়ে অন্ধ বানানোর একটা প্রক্রিয়া চলছে বলে ক্ষুব্ধ মানুষজন বলাবলি করছেন। এসব ঘটনায় অনেকে আবার ‘ক্রান্তিকাল’ ও ‘দুর্যোগের ঘনঘটা’ দেখছেন। ‘ক্রান্তিকাল’ ও ‘দুর্যোগের ঘনঘটা’ অবশ্য আমাদের দেশে নতুন নয়।
‘বাংলার আকাশে’ যে কবে প্রথম ‘দুর্যোগের ঘনঘটা’ শুরু হয়েছিল, তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে অনুমান করা যায় যে, অনাদিকাল থেকেই এখানে ‘দুর্যোগের ঘনঘটা’ চলছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এতো দুর্যোগের পরও কিন্তু দেশটা ধ্বংস হয়ে যায়নি! পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ, অতি খারাপ, মারাত্মক খারাপ হয়েছে এবং হচ্ছে; তারপরও কিন্তু দেশটা দিব্যি টিকে আছে। এতো দুর্যোগের পরও দেশের লোকসংখ্যা কমেনি। পরিবার পরিকল্পনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সড়ক দুর্ঘটনা, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, লঞ্চ ডুবে মৃত্যু, সন্ত্রাসীদের হাতে মৃত্যু, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, রোগ-শোক কোনও কিছুই জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতিকে থামাতে পারেনি। অথচ ‘ক্রান্তিকাল’ বা ‘দুর্যোগের ঘনঘটা’ চলছেই।
ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি- দিনকাল খুব খারাপ। চারদিকে উত্তেজনা, মারামারি-কাটাকাটি-ফাটাফাটি, হিংসা, খুন, সন্ত্রাস, দলাদলি, ব্যাভিচার, মৌলবাদি তাণ্ডব। এসবের ফল একটাই- দিনকাল খুব খারাপ। এই ‘দিনকাল খুব খারাপ’-র দৈর্ঘ্য যে কতো বড়, তা সম্ভবত কেউ জানে না। দিন যতই যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততোই খারাপ হচ্ছে। সমাজে অস্থিরতা, ভয়, আতঙ্ক বাড়ছে। শান্ত-স্বস্তি-স্থিতি সব যেন চিরতরে হারিয়ে যেতে বসেছে। সবাই কেমন মারমুখী, আক্রমণাত্মক। ভাই বলেও রেহাই মিলছে না; 'শালা' বলে তেড়ে আসছে। প্রত্যেকে যেন প্রত্যেকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কেউ কারও বন্ধু নয়; সবাই সবার শত্রু, পথের কাঁটা। সবচাইতে বড় শত্রুতা ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে। পরস্পরকে দেখে নেওয়ার, শিক্ষা দেওয়ার বিরামহীন প্রতিযোগিতা চলছে যেন।
বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের নীতি হচ্ছে, ‘যে আমার সঙ্গে নেই, সে আমার বিরুদ্ধে'। এক্ষেত্রে সন্ত্রাসী-অপরাধী, সুবিধাবাদী গোষ্ঠী আর মৌলবাদী-ধর্মব্যবসায়ী ছাড়া আর কাউকে সরকারের পক্ষ নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে চিরশত্রু বিরোধী দলের সঙ্গে সঙ্গে দলনিরপেক্ষ নিরীহ সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেও ক্ষমতাসীনদের জেহাদ চলছে। সুবিধাবাদী, সন্ত্রাসী-অপরাধী আর মৌলবাদীরা ছাড়া অন্য সবার বাপের নাম ভোলাতে, তাদের ভিটায় ঘুঘু চরাতে ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক তৎপরতা চালাতে দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা, প্রশ্রয় ও মদদে সন্ত্রাসী আর মৌলবাদীরা ক্রমেই শক্তিশালী ও হিংস্র হয়ে উঠছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মাত্রই এ হিংস্রতার নির্মম শিকারে পরিণত হচ্ছেন। অথচ কেউ কিছু বলতে বা করতে পারছেন না। বাংলার আকাশে এমন ভয়াবহ ও সর্বগ্রাসী দুর্যোগের ঘনঘটা অতীতে কখনও দেখা গেছে বলে মনে হয় না।
কৈশোরে এক রাজনৈতিক নেতার বক্তৃতা শুনেছিলাম। তিনি মাইকে চিৎকার করে বলছেন, ‘ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আজ আপনাদের প্রতি আহ্বান, আপনারা গর্জে উঠুন, দুঃশাসনকে বাংলার মাটিতে চিরতরে কবর দিন...'। ইতিহাসের সেই ক্রান্তিকাল চলছে তো চলছেই। প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বড় দীর্ঘ এই ইতিহাসের ক্রান্তিকাল। যেন এর শুরু আছে, শেষ নেই। ক্রান্তিকাল ক্রমেই আরও দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। মাঠ-ময়দান থেকে দূরাগত মাইকে, জননেতাদের বক্তৃতায়, বিবৃতিতে, সংবাদপত্রের ক্ষুরধার রাজনৈতিক কলামে, অফিস-আদালতে, আড্ডায়, নাটকে-সাহিত্যে, এখনও ‘ইতিহাসের ক্রান্তিকালে’-র বিরামহীন উচ্চারণ অব্যাহত আছে। পৃথিবীতে কত কী অদল-বদল হয়েছে, শুধু নেতানেত্রীদের সেই বুলি- ‘ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে’ অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। যেন সচীন সেনগুপ্তের সিরাজ-উদ-দৌলার ভাঙা রেকর্ড বাজছে- ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা'। বাংলার এই ‘ভাগ্যাকাশ’ যে কবে নাগাদ দুর্যোগমুক্ত হবে আর কবে আমরা স্নিগ্ধ শ্যামল আকাশ দেখতে পাবো, সেটা একটা জটিল ধাঁধা। মোশতাক-জিয়া-সাত্তার-এরশাদ-খালেদা-হাসিনা-খালেদা-হাসিনা- গত সাড়ে তিন দশকে ক্ষমতায় কতোজন এলো-গেলো; কিন্তু ইতিহাসের ‘ক্রান্তিকাল’ কিংবা ‘ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা’ আমরা কারোর হাত ধরেই উতরাতে পারিনি। প্রত্যেক শাসনামলই ছিল ‘খারাপ সময়’। এক খারাপ সময় অতিক্রম করে আরেক ‘খারাপ সময়ে পৌঁছেছি; কিন্তু সুসময় বা সুদিনের দেখা পাইনি। ছোটবেলায় বাড়িতে আড্ডা বসতো, প্রতিবেশী প্রবীণরাও সে আড্ডায় অংশগ্রহণ করতেন। স্থানীয় রাজনীতি, হানাহানি, কাটাকাটি, চুরি-ডাকাতি, পারিবারিক সঙ্কট, দাম্পত্য কলহ, প্রেম-বিয়ে, বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি, খেলাধুলা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এলোপাতাড়ি আলোচনা হতো। এসব আলাপ-আলোচনার শেষ কথা বা সারমর্ম ছিল- আসলে সবকিছু দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ঘোর কলিকাল শুরু হয়েছে। দিনকাল খুবই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সাবধান, খুব সাবধান। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যাদের মুখে এ ধরনের সাবধানবাণী বেশি শোনা যেতো, তারাই বিপদগ্রস্ত হতেন বেশি!
আমাদের দেশের গণমানুষ কিন্তু এখনও যথেষ্ট সাবধানী। অনেক হিসাব-নিকাশ করেই তারা পথ চলেন, সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এত সাবধানী হয়েও তাদের কোনও লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না। যখন যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তখন তারাই অসংযমী ও বেপরোয়া হয়েছেন। ফলাফল সেই একই- সাধারণ মানুষের সর্বনাশ। সর্বনাশ হতে হতে এর মাত্রাটা বেড়ে সাড়ে সর্বনাশে গিয়ে পৌঁছেছে। সাবধানের মার নেই- কথাটা অচল হয়ে গেছে। শত সাবধানতা সত্ত্বেও মার খেতে হচ্ছে। আর তা হবে না-ই বা কেন? যারা আক্রমণকারী, উদ্ধত, সেই সন্ত্রাসীরা তো আর সাবধানী হচ্ছে না। তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড থামানোর কোনও আয়োজন নেই। সরকার অনেক ক্ষেত্রেই সমালোচনা, আইন-নীতির তোয়াক্কা না করে সন্ত্রাসী-অপরাধী কুলাঙ্গারদের পক্ষ নিচ্ছে। ফলে এসব অপশক্তি নির্বিঘ্নে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ ও নিরীহরা সাবধানী হয়েও মার খাচ্ছে, বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে দিনকাল আরও খারাপ হচ্ছে ‘ক্রান্তিকাল’ কিছুতেই কাটছে না!
এই ‘ক্রান্তিকাল’ কবে শেষ হবে, কবে?
লেখক: কলামিস্ট