এই ঘটনাদুটি সরকারের জন্য একটি সতর্কবার্তা। জঙ্গিরা যে দুর্বল হয়ে যায়নি, সুযোগ পেলে তারা পুলিশ-র্যাবকেও ছেড়ে কথা কইবে না, আশকোনা ও খিলগাঁওয়ের হামলার ঘটনাটিদুটি সেই ম্যাসেজই দিয়ে গেল।
সরকারের উচিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আরও আটঘাট বেধে নামা। একথা ঠিক যে গেল বছর গুলশান হোলি আর্টিজান ও শোলাকিয়া ঈদগাঁহ ময়দানে জঙ্গি হামলার পর থেকে সরকার জঙ্গি দমনে কঠোর ভূমিকা পালন করে আসছে। বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কোনও ধরনের অনুরাগ বা অনুকম্পা না দেখিয়ে জঙ্গি পরিচয় পেলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চড়াও হচ্ছেন। অনেক জঙ্গিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযান জনমনে আপাত স্বস্তি দিলেও পুরোপুরি ভরসা দিতে পারছে না। কারণ বিভিন্ন স্থানে জঙ্গির সন্ধান পাওয়া মানে হচ্ছে দেশে জঙ্গি তৎপরতা থেমে নেই। তারা আক্রমণ করতে পারছে না বটে, কিন্তু গোলাবারুদ-বিস্ফোরক নিয়ে ঠিকই গোপনে সংগঠিত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাদের গ্রেফতার করছে বা গুলি করে মেরে ফেলছে, তাদের বাইরেও নিশ্চয়ই আরও একটা বড় অংশ রয়ে গেছে, যারা পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বড় কোনও ঘটনা ঘটাবার জন্য তৈরি হচ্ছে! এটা আমাদের জন্য মোটেও স্বস্তির খবর নয়।
মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশটি জঙ্গিরাজনীতির জন্য খুবই উর্বর একটি ভূখণ্ড। এখানকার মানুষরা বেশিরভাগই ধর্মভীরু। ধর্মের দোহাই দিয়ে, ভুলভাল বুঝিয়ে সহজেই এখানকার মানুষকে ক্ষেপিয়ে দেওয়া যায়। জঙ্গিমন্ত্রে দীক্ষিত করা যায়। আর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি চর্চার অভাবের কারণে এখানে ধর্মীয় রাজনীতি খুবই বাড়-বাড়ন্ত। শুধু ধর্মভিত্তিক দলগুলোই নয়, বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক নেতাকর্মীও ধর্মের ব্যাপারে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। এখানে জঙ্গিবাদের সমর্থক মানুষের সংখ্যা এখনও উদ্বেগজনক ভাবে বেশি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মবাদী উগ্রপন্থী সমর্থকদের দৌরাত্ম প্রকট ভাবে দৃশ্যমান।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এই দেশে এক যোগে সারাদেশে ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। দেশের সবগুলো জেলায় সংগঠিত জঙ্গিগোষ্ঠী এই ঘটনা ঘটিয়েছিল। তারা নিশ্চয়ই নিঃশেষ হয়ে যায়নি। শুধু তাই নয়, যুদ্ধাপরাধের বিচারের ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত, সেই সব পরিবার, যারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে না, সেই জামায়াত-শিবিরচক্র-তারাও এখন জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়-সহযোগিতা দেবে-এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল, যারা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করছে, যারা ক্ষমতাসীনদের দ্বারা কমবেশি নিপীড়িত তাদের কোনও অংশ যদি জঙ্গিদের প্রত্যক্ষ সহায়তা ও মদদ দেয়, সেটাও বিচিত্র নয়। কাজেই এদেশে জঙ্গিবাদ বিকাশের জন্য খুবই অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান রয়েছে। পুরো পরিস্থিতিই জঙ্গিবাদের জন্য একটি আদর্শভূমি। এখানে শুধু বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত কিছু প্রশাসনিক উদ্যোগ দিয়ে জঙ্গিবাদী তৎপরতা বন্ধ করা খুব কঠিন। এর জন্য ব্যাপক ও বিস্তৃত উদ্যোগ নিতে হবে।
গত কয়েক মাসে জঙ্গিবিরোধী বিভিন্ন অভিযানে শীর্ষজঙ্গিদের অনেকেই নিহত হয়েছে। গত বছরের২৬ জুলাই ঢাকার কল্যাণপুর সাড়ে ৬ ঘণ্টার অভিযানে ৯ জঙ্গি, ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ সাড়ে ৬ ঘণ্টার অভিযানে ৩ জঙ্গি, ৮ অক্টোবর গাজীপুর (পাতারটেক) পুলিশের ৬ ঘণ্টার অভিযানে ৭ জঙ্গি, (হাড়িনাল) র্যাবের ২ ঘণ্টার অভিযানে ২ জঙ্গি, ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার আশকোনায় ১৬ ঘণ্টার অভিযানে ২ জঙ্গি এবং সর্বশেষ গত ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ১৯ ঘণ্টার অভিযানে ৪ জঙ্গিসহ পাঁচ জন নিহত হয়। এ ছাড়া ১৭ মার্চ আশকোনায় ও ১৮ মার্চ খিলগাঁওয়ে ১জন করে জঙ্গি নিহত হয়। এই সংখ্যাগুলো কিন্তু আমাদের খুবই ভীতিকর খবর! তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে, তবু তারা দমছে না। উল্টো আত্মঘাতী হচ্ছে। যারা নিজেরাই মরতে চায়, তাদের মেরে কি নিঃশেষ করা যাবে? বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। কেউ যেন জঙ্গিভাবধারায় আকৃষ্ট না হয়, সেই চেষ্টা সবেচেয়ে বেশি করা দরকার।
বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে আইএসের কানেকশন আছে কি-না, সেটা নিয়ে মাঝে মাঝে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও তা অবান্তর। মূল বিষয় হচ্ছে দেশে জঙ্গি আছে, তারা তৎপরতা চালাচ্ছে-আমাদের আসল ভয়টা তো এখানেই। কোন দেশের কোন দলের জঙ্গি তাতে কী এসে যায়? জঙ্গি মাত্রেই সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক। রাজনীতির পণ্ডিতেরা এই ঘটনার যে তাৎপর্যই বের করুন, জঙ্গি দমনে বর্তমান সরকার সময়োচিত এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছেন, আর তা দেখে দেশের মানুষ একটু স্বস্তি বোধ করছেন। বেপরোয়া জঙ্গিদের সামনে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চেয়ে অসহায় আর কে! তাই দেশের মাটিতে জঙ্গিদের কিছুমাত্র মাথাচাড়া দিতে দেখলেই সরকার সর্বশক্তি দিয়ে তাদের নির্মূল করবে—সবসময় মানুষ তেমনটাই প্রত্যাশা করেন।
জঙ্গি দমনের ব্যাপারে সবাইকে দায়িত্বশীল ও একজোট হতে হবে। এটা শুধু সরকার বা পুলিশ-র্যাবের বিষয় নয়। যারা গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারে বিশ্বাস করে তাদের সবাইকেই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে একাট্টা হতে হবে। জঙ্গিরা যেন কারও কাছ থেকেই কোনও রকম আশ্রয়-প্রশ্রয়-সহানুভূতি না পায়-তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে সব সময়ই জঙ্গি বিরোধী অভিযানকে ‘সাজানো অভিযান’ বলা হয়। সত্যিই কি অভিযানগুলো সাজানো অভিযান? এ কথা হয়তো ঠিক যে, আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেক সময় নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে কিংবা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কখনও কখনও সাজানো অভিযান পরিচালনা করেন, বানানো ঘটনার বর্ণনা দেন। কিন্তু তাই বলে জঙ্গিবিরোধী সব অভিযানই সাজানো? মিথ্যে? এটা বলা কী ঠিক? তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আত্মবিশ্বাস-‘ক্রেডিবিলিটি’ বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকে কী?
এক শ্রেণির মানুষ বিএনপির এ ধরনের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। তারাও জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিবিরোধী সরকারি ভূমিকাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। জঙ্গিবাদী রাজনীতি যে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা, এর প্রতিরোধ যে সম্মিলিত ভাবে করা দরকার সেই তাগিদ ও দায় কারও মধ্যে তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। আর সম্মিলিত এই উদাসীনতার সুযোগে মৌলবাদীরা ক্রমেই শক্ত-পোক্ত হচ্ছে। তারা র্যাবের ওপর হামলারও দুঃসাহস দেখাচ্ছে।
জঙ্গিদের ব্যাপারে বিএনপিরও আরও দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়া মনগড়া অভিযোগ জঙ্গিদের হাতকেই শক্তিশালী করে। বিএনপি যদি এই ভূমিকা অব্যাহত রাখে, সেক্ষেত্রে জঙ্গিদের পাশাপাশি বিএনপির সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কারণ যারা দেশের শত্রু, জাতির শত্রু, মানবতার শত্রু, সেই জঙ্গিদের ব্যাপারে কারও কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্য, প্রশ্রয়, সহানুভূতি সমর্থন কিংবা গাফিলতি মেনে নেওয়া যায় না।
গোষ্ঠীবিশেষের মূঢ়তার কারণে বাংলাদেশকে আমরা পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে দিতে পারি না। এ ব্যাপারে দেশের প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে সোচ্চার হতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট