সে রাতের হত্যাযজ্ঞে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মরেছে, শিক্ষক মরেছে, কর্মচারী মরেছে। প্রতিবাদমুখর ছাত্রদের যে মধুদা চা-সিঙ্গারা খাইয়ে প্রশান্তি দিতো, মরেছে সে মধুদাও- সপরিবারে। মরেছে একটি বটবৃক্ষ; যার তলায় দাঁড়িয়ে ছাত্ররা একটি স্বাধীন দেশের জন্য স্লোগান দিতো, স্বাধীন দেশের স্বপ্নসুখে বিভোর হয়ে হলুদ মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের একটি পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিল। সে রাতে মরেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখি, ফুল, বই-পুস্তকসহ জীবন্ত-সজীব সবকিছুই। পাকিস্তানি বাহিনী যাকে যেখানে যেভাবে পেরেছে নির্দয়ভাবে মেরেছে। তারা মনে করেছে, প্রতিবাদ ও আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্র-শিক্ষক সমেত ধ্বংস করে দিতে পারলেই প্রতিবাদের আগুনে পানি ঢালা হবে। তারা ভুল ভেবেছে। ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বন্দুক আর কামানের গোলায় তারা সেদিন প্রতিবাদের আগুনে যে পানি ঢেলেছে, তা মূলত ঘি হয়ে মুক্তির সংগ্রামকে, মুক্তিযুদ্ধকে করেছে আরও বেগবান, তেজোদ্দীপ্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) সেসময়ে ছাত্রনেতাদের পদচারনায় মুখরিত ছিল। প্রয়োজনীয় সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অধিকাংশই আসতো এই হলের কক্ষগুলোতে আলোচনা করে। আসতো সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কর্মকৌশলও। পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মার্চ রাতে হামলা করে ইকবাল হলে। হত্যা করে এলোপাথাড়ি। জগন্নাথ হল ছিল মূলত হিন্দু অধ্যুষিত। পাকিস্তানিরা বাঙালি জনগণের ন্যায্য দাবি-দাওয়াকে হিন্দুদের প্ররোচনা বলে আখ্যায়িত করতো। সে রাতে হামলা হয় জগন্নাথ হলে। নিথর দেহগুলোকে অপমান করে পুতে ফেলা হয় হলের মাঠে। রোকেয়া হলের ছাত্রীরা একাত্তরের মার্চের শুরুতেই কলা ভবনে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের ট্রেনিং শুরু করে অসীম সাহসিকতার সাথে। ২৫ মার্চ রাতে হামলা ও অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় রোকেয়া হলের ছাত্রীদের ওপর। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী সবসময় ছাত্রদের সমান্তরালে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় এ রাতে মহান সেসব শিক্ষকদের ওপরও নিকৃষ্ট হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পর আমার সুযোগ হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার। এখানে এসে আমি অনুভব করি, এখানকার প্রতি ইঞ্চি মাটিতে মিশে আছে স্বাধীনতাপাগল এক জনগোষ্ঠীর সংগ্রামের কথামালা। এ মাটিতে হাঁটার সময় প্রতি মুহূর্তে আমি দ্বিধান্বিত থাকি, ‘না জানি কোন মহান শহীদের বুকের তাজা রক্তভেজা মাটিতে পা রেখে আমি অপমানিত, অসম্মানিত করছি তাঁর অবদানকে’। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমি নিজে থেকেই সব জেনে নিয়েছি। গাছ, পাতা, ফুল, দালান, লাইব্রেরিতে রাখা বই, হল ও কলা ভবনের কক্ষ, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্ত, মধুর ক্যান্টিনের চা, বটতলার শীতল ছায়া, সবুজ ঘাস সবকিছু আমাকে জানিয়ে দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মহত্বের কথা, ত্যাগের কথা, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত পাকিস্তানি বাহিনীর রক্তের লীলাখেলার কথা। আমি জেনেছি আর ঋণী হয়েছি। ঋণী হয়েছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে।
এ বছর বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদ একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের সেই ভয়াল হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। দিনটিকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। সংসদ ও সরকার শহীদের ঋণ শোধের প্রয়াস পেয়েছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের তরুণ প্রজন্ম ও আন্তর্জাতিক পরিসরে আজও তুলে ধরতে পারেনি, প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, একটি বিশ্ববিদ্যালয় কত নিষ্ঠুর ও পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারে তা। ২৫ মার্চ রাতের সেই হত্যাকাণ্ড এবং একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড পঙ্গু করে দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে, বাংলাদেশকে। আমরা আজও সে পঙ্গুত্ব থেকে মুক্তি পাইনি। ততদিন মুক্তি পাবো না, যতদিন না আমরা দেশের প্রতিটি প্রজন্মের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব, অবদান ও ত্যাগকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারবো।
লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ এবং পরিচালক, সিআরআই