আমার মতো পেশাগতভাবে যারা সংবাদকর্মী; সেই তাদের ক্ষেত্রে একটি বোমা হামলা কিংবা বন্দুক হামলা, কিংবা বিমান থেকে সমানতালে বোমা নিক্ষেপ; সবই যেন এক একটা ইভেন্ট। কে কত ভেরিয়াস অ্যাঙ্গেলে কাভার করতে পারে সেটাই আসল কথা! যত কাভারেজ ততো পাঠক, যত পাঠক ততো ট্রাফিক, যত ট্রাফিক, ততো বিজ্ঞাপন। অস্ত্র বিক্রির দানবীয় বহুজাতিকগুলোর কাছে যুদ্ধ মানেই রমরমা ব্যবসা। সামরিক বাহিনীর উঁচু তলার কর্মকর্তাদের জন্য অর্থ ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চর্চার মোহনীয় সুখ। আর যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়কদের ক্ষেত্রে জঙ্গি/সন্ত্রাসী হামলা সম্ভবত এক অপরিহার্য গন্তব্য, ‘বড়’ কোনও তাৎপর্যপূর্ণ ‘ঘটনা’! যেমনটা ঘটেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে। লন্ডনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হামলাকে ‘বড় খবর’ আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
বাংলা ট্রিবিউনের আন্তর্জাতিক সংবাদ নির্মাণের ক্ষেত্রে সকাল বেলা সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে যতোদূর সম্ভব একটি ইতিবাচক আশা জাগানিয়া খবর দিয়ে দিন শুরু করার। বেশিরভাগ দিনই সেটা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে যুদ্ধ-ধ্বংস-রক্তপাত সংক্রান্ত কোনও একটা খববের প্রচণ্ডতায়। বলা বাহুল্য সারা বিশ্বের বিবেচনায় যুদ্ধ-ধ্বংস-রক্তপাত সংক্রান্ত খবরের বড় জায়গাটই বরাদ্দ করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। সেই যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প লন্ডনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হামলার মধ্যে ‘বড় খবর’ দেখছেন! কিন্তু সেটা কেন?
আসলে সামরিকতায় এখনও টিকে থাকলেও ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেছে মার্কিন সাম্রাজ্য। আশির দশকের রিগ্যান-থ্যাচার যুগের নব্য উদারবাদী মুক্তবাজারের মুখোশ খসে পড়েছে। জনগুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় তথ্য ফাঁস করে ন্যায়-সাম্য-মানবিকতার সাম্রাজ্রিক মুখোশ টেনে-হিচড়ে বের করে এনেছেন স্নোডেন-অ্যাসাঞ্জরা। সবমিলে যুক্তরাষ্ট্র আজ আর একক সুপার পাওয়ার নয়। নয় সেই জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য। পতন্মোমুখ মার্কিন সাম্রাজ্যে সদ্য দায়িত্ব নেওয়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন একজন আত্মঘাতী প্রতিনিধি। যেন অনিবার্য ধ্বংসযজ্ঞ সাধনের নিমিত্ত হয়ে এসেছেন অস্তমিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা এক সাম্রাজ্যের আত্মঘাতী এই সম্রাট। ইসলামফোবিয়ার ভীতি-ভাইরাস ছড়িয়ে মার্কিন সমাজের অভ্যন্তরে বিভক্তিজনিত বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। বিপরীতে ফেরি করে চলেছেন যুদ্ধ আর যুদ্ধান্মদনা। মানুষের হতাহতের ঘটনাকে ভূরাজনৈতিক কর্তৃত্বগত অবস্থান থেকে বিচার করেই ট্রাম্প মুখ ফসকে সত্যি কথাটা বলে ফেলেছেন। ব্রিটেনের হামলা সত্যিই তাদের কথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের বাস্তবতায় বড় ঘটনা। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রশ্নে। মানুষের জীবন সেখানে তুচ্ছ।
ট্রাম্পের ধ্বংসন্মোদনার সমান্তরালে ধ্বংসপথে হেঁটে চলেছে আজকের যুদ্ধ-অর্থনীতি নির্ভর মার্কিন সামরিক-সাম্রাজ্য। কী হাল ক’দিন আগেও শক্ত কোমড়ে আগ্রাসন জারি রাখা সুপার পাওয়ার আমেরিকার? রাজনৈতিক লড়াইয়ে ১৮৫০ সালের পর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে যুক্তরাষ্ট্র। সেইসময়ের পর এখনই আমেরিকার বিভাজন ও মত অনৈক্য সবচেয়ে বেশি। ১৯৯১ সালে ভেঙে যাওয়ার আগে ক্ষমতার শীর্ষে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর গত ১৫ বছরে বরং অনেকটাই ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে যু্ক্তরাষ্ট্রের। বিশাল ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল সামরিক বাহিনী থাকা সত্ত্বেও ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ জয়ে ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নিতে পারছে না সিরিয়ার দখল। মার্কিন সাম্রাজ্যের ধস স্পষ্টভাবে জনমানুষের সামনে হাজির হয়েছে। এই বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন সমাজের গভীরে থাকা বিভক্তির বীজগুলোকে সুপ্ত করে ট্রাম্প তাই নতুন সামরিক-অর্থনৈতিক-সাম্রাজ্যিক বাসনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেই সময়কার মার্কিন জাতীয় শত্রু কমিউনিজমকে সরিয়ে নতুন মার্কিন জাতীয় শত্রুর ভূমিকায় আবির্ভূত হয় ইসলাম। টার্গেটে পরিণত হয় মুসলমানরা। ৯/১১ টুইন টাওয়ার হামলার পর নিশানা জোরালো হয়। ওই কালপর্বকে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় যুদ্ধ’ নামে ডাকেন সুবিখ্যাত মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোম চমস্কি। বুশ যুগের মতো করেই ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন সামনে এনেছেন। আর এর বিপরীতে হুমকি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন মুসলমানদের। ভীতি ছড়াতে চাইছেন জনমনে। সবমিলে ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ’-এর নামে তিনি আদতে ইরাক-আফগান যুগে ফিরতে চাইছেন।
টুইন টাওয়ার হামলার পর বিন লাদেনকে সহযোগিতার অজুহাত তুলে আফগান সভ্যতা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন লাখ লাখ মানুষ। স্নায়ুযুদ্ধের কালে সোভিয়েতবিরোধী লড়াইয়ের জন্য সিআইএর প্রত্যক্ষ মদদে যে মুজাহিদিনদের জন্ম দেওয়া হয়; লাদেন ছিলেন তাদেরই একজন! পরে বিদ্রোহ করেন। সাদ্দাম হোসেনও মার্কিন মদদে হাজার হাজার কুয়েতিকে মেরেছিলেন। সেই সাদ্দাম বিদ্রোহী হয়ে উঠলে ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ্যে অভিযোগে হামলা হয়েছিল ইরাকে। হত্যা করা হয়েছিল ৫ লাখ ইরাকি শিশুকে, গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল মেসোটটেমিয়ার এক দুর্দান্ত সভ্যতা। বেআইনি কায়দায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল সাদ্দামকে।
ইতিহাসের এ এক নিমর্ম পরিহাস, আজকে আইএস নামে যারা হাজির আছে তারা সাদ্দামের পতন পরবর্তী গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের ফলাফল। ট্রাম্প সেই আইএস নির্মূলের নাম করেই চেষ্টা করছেন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মার্কিন আধিপত্য আরও নিরঙ্কুশ করার। এ কারণেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টকেন্দ্রিক হামলা তদার কাছে বড় কিছ হয়ে যায়। হয়ে যায় তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা সেখানেও সুইসাইড বম্বিং, সেখানেও মুসলিম প্রশ্ন, সেখানেও সন্ত্রাসবাদ রয়েছে। স্বভাবতই ট্রাম্প ভাবতে পারেন, এবার বুঝি অজুহাত পাওয়া গেল।
দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় ট্রাম্প মুসলিমবিরোধী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। শপথ নিতে গিয়ে তিনি বুশযুগের কথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের মতোই ‘পবিত্রযুদ্ধ’ আর ‘বিধাতা’র প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসেন। প্রশাসনে ইরাক-আফগান-ভিয়েতনাম যুদ্ধের সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেন শীর্ষ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনেরই একটা অংশ। সেই তাদের রিপোর্টে তথ্য রয়েছে, প্রথম ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় পড়া সাত দেশের নাগরিকরা যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সন্ত্রাসের সঙ্গে খুব একটা জড়িত নয়। আর ব্যক্তি পর্যায়ের কোনও হামলা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সন্ত্রাসী হুমকি হতে পারে না। মার্চের এক নথির চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো বেশিরভাগ অভিবাসী সন্ত্রাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে না। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের পরে এমন পথ বেছে নেয়। কয়েক বছর ধরে তাদের ওপর বৈষম্য, মানসিক যন্ত্রণার কারণে ক্ষুব্ধ কিংবা হতাশ হয়ে সন্ত্রাসের পথে পা বাড়ায়।
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যনীতি তাই মার্কিন আগ্রাসনের বাসনা ছাড়া কিছুই নয়। এরই মধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধের পরিকল্পনা। তুরস্ক সফর করেছেন সিআইএ প্রধান। সিএএন-এর অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, প্রেসিডেন্টের অনুমোদন ছাড়াই স্বাধীনভাবে ইয়েমেন, লিবিয়া এবং সোমালিয়াতে কথিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনার ক্ষমতা পেয়েছে মার্কিন সেনাবাহিনী। পাশাপাশি ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যুদ্ধে ড্রোন ব্যবহারের অধিকার পেতে যাচ্ছে তারা। দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ৫ দিনের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আল কায়দার বিরুদ্ধে ইয়েমেনে এক বিশেষ অভিযানের অনুমোদন দিয়েছিলেন। ওই অভিযানে বেশ কয়েকজন নারী ও শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল। অভিযান চালাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন একজন মর্কিন সেনা।
সামরিক-সাম্রাজ্যের শত্রু লাগে। শত্রু ছাড়া তারা কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? যুদ্ধ না করলে অস্ত্র বিক্রি হবে কী করে? অস্ত্র বিক্রি না হলে ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থ রক্ষা হবে কিভাবে? ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থ রক্ষা না হলে যুদ্ধাস্ত্র-নির্ভর মার্কিন অর্থনীতি টিকবে কি করে? সোভিয়েত পতনের পর থেকে ইসলামই সেই শত্রু। নাইন ইলেভেনের পর থেকে সেই শত্রুতা আরও প্রকট হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সমরাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা খরচ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি) জানাচ্ছে, ২০০১ সালে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে কার্যত মার্কিন সেনাবাহিনী স্থায়ীভাবে যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী সংগঠন প্লাওশেয়ার্স ফান্ডের তথ্য বলছে, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ভারত, পাকিস্তান, চীন ও ইসরায়েলেল মতো বিশ্বের অন্যান্য পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোও মনে করে ২০০-৩০০ পারমাণবিক অস্ত্র যথেষ্ট। বিপরীতে রাশিয়ার হাতে ৭ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ৬ হাজার ৮০০টি। ফেব্রুয়ারিতে স্টার্ট চুক্তির ব্যাপারে পুতিনের সঙ্গে কথা বলেন ট্রাম্প। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই সংখ্যা কমাতে চাইলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প বাড়ানোর পক্ষে।
‘নব্য উদারবাদী অর্থনীতির ভাইরাস সমাজে বৈষম্য বাড়িয়েছে দিনকে দিন। ব্যর্থ হয়েছে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। আমেরিকা ফার্স্ট’ নামের সংরক্ষণশীল অর্থনীতির রূপরেখা নিয়ে মার্কিন রাজনীতির মঞ্চে হাজির হন এই আবাসন ব্যবসায়ী। ৩০ এর দশকের গ্রেট ডিপ্রেশনখ্যাত মহামন্দার পর রিগ্যান যুগে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপহীন মুক্তবাজার অর্থনীতি ৭০ থেকে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত দুর্দান্ত প্রতাপ বজায় রাখলেও এখন এসে তা মার্কিন সমাজে অর্থনৈতিক হতাশা তৈরি করেছে তীব্রভাবে। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মহামন্দার সময় থেকে ওই ক্ষরণ শুরু হয়। সম্প্রতি অক্সফাম এক গবেষণায় ওই অর্থনীতির দিন শেষ উল্লেখ করে নতুন ধারার বিকল্প অর্থনীতি প্রস্তাব করেছেন। ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবী মার্কিনিদের অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। এজন্যই মেক্সিকান-মুসলামনসহ অভিবাসীদেরকে শ্বেতাঙ্গদের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। বোঝাতে চেয়েছেন ওরাই প্রকৃতপক্ষে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকনদের দুরাবস্থার জন্য দায়ী। সবমিলে বিভক্তির বীজ বপনে সক্ষম হন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের সামরিক বাজেট ওবামার চেয়ে ৩০ বিলিয়ন ডলার বেশি। সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির ফেলো এবং সিআইএর সাবেক বিশ্লেষক মেলভিন গুডম্যান ট্রাম্প প্রস্তাবিত বাজেটটিকে সামরিকতার জাতীয় নিরাপত্তা রীতির বিকশিত ধাপ বলেছেন। ট্রাম্পের পরিকল্পনাকারী স্টিভ ব্যাননের ভাষায় যা ‘প্রশাসনিক অবস্থার বিনির্মাণ’। এদিকে বার্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক জেমস পেট্রাস ২১ শতকের দুই দশকে মার্কিন সামরিকতার এই বিস্তৃতিকে বলছেন ‘অভূতপূর্ব’।
জন্মলগ্ন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেই বিশ্বজুড়ে তার আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছে। তবে তাদের এই সাম্রাজ্যবাসনার ধরনধারণ স্থির থাকেনি।স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ছদ্মবেশে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবেই হাজির থেকেছে, সেখানে আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রকাশ্যে হাজির হচ্ছে সামরিক ঘোষণা জারি করে। জন বেলামি ফস্টার একেই বলেছেন ‘নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ।’ ২০০৩ সালে প্রকাশিত নেকেড ইম্পিরিয়ালিজম বইতে বলতে চেয়েছেন: বিশ্বব্যবস্থা ‘নতুন সামরিকবাদ’ ও ‘নতুন সাম্রাজ্যবাদ’-এর আকারে হাজির হয়েছে। বিকল্প অর্থনীতির অনুপস্থিতিতে নব্য উদারবাদ সামরিক সাম্রাজ্যবাদকেই গন্তব্য করেছে। কেউ কেউ একে বলে থাকেন ওয়ার ইকোনমি যুগ বা যুদ্ধ অর্থনীতির যুগ। যুগটা সামরিক-সাম্রজ্যনির্ভরতার। সংঘাত তাই এখানে অনিবার্য বাস্তবতা।
তবে মার্কিন সামরিক সামরিক সাম্রাজ্য চিরন্তন নয়। সম্প্রতি লন্ডন হামলার পর আবারও আত্মঘাতী হামলা ঠেকানোর সামরিক পথ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিবিসির বিশ্লেষণে বলা কৌশলের দিক বিবেচনায় নিলে সংঘটিত হামলাটি একেবারে সাম্প্রতিক নতুন ধারার সন্ত্রাস। আগে মনে করা হতো, একটি সন্ত্রাসী হামলা চালাতে ভারী বিস্ফোরক লাগবে। লাগবে সুদীর্ঘ পরিকল্পনা। আর এই হামলাকারী খুব বেশি প্রযুক্তির আশ্রয় নেননি। বিশ্লেষণে দেখানোরা হয়েছে, কোনওভাবেই সামরিক পন্থায় এই ধারার 'লোন উল্ফ' হামলা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাই মুসলমানদের জাতীয় শত্রু বানিয়ে, আত্মঘাতী হামলাকে জেহাদী বাস্তবতা আকারে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে লাভ হবে না।
স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে মুসলমাদের নতুন জাতীয় শত্রু বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় তাদের ওপর যে শোষণ-বঞ্চনা চালানো হয়েছে, চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে আজও পর্যন্ত তাকে আড়াল করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সাম্রাজ্য বাসনা জারি রাখা সহজ হবে না খুব বেশি দিন। নোম চমস্কি, অরুন্ধতী রায়, তারিক আলীসহ বিশ্বখ্যাত বুদ্ধিজীবীরা বারবার বলছেন, নজর ফেরাতে হবে সমাজের বিরাজমান শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন আর বৈষম্যে। নজর ফেরাতে হবে মানুষের পরাধীন জীবনে। সৌদি বংশোদ্ভূত মার্কিন নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ তাই সুইসাইড বম্বিং বইতে ইতিহাসে নজর ফিরিয়ে দেখিয়েছেন, বস্তুত এই আত্মঘাতী বোমাবাজি ইসলামি ভাবধারা থেকে আসেনি। এসেছে নেশন স্টেটের ভাবধারা থেকে। আমরা যেমন দেশের স্বার্থে জীবন বলিদানের কথা বলি, তেমনই খিলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর তরুণ মুসলিমরা শহীদ হতে চান। পলিটিক্যাল ইসলামের ক্রীড়ানকেরা স্বাধীনতাকামী তরুণদের আকাঙ্ক্ষাকে ‘জিহাদি’ উন্মাদনার বিষে বিকৃত করছে। জিহাদের নামে মানুষ মারছে, উন্মুখ সাম্রাজ্য বাসনায় দখল করতে চাইছে বিশ্বকে। আর যারা ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ’ জারি রেখেছে, তারা সাম্রাজ্য অক্ষুন্ন রাখতে চাইছে যেনতেন উপায়ে। এই দুই পক্ষের লড়াইয়ের বলি হচ্ছে মানুষ। এই লড়াইয়ের অবসান কবে হবে, আমি তা পাঠককে আগে থেকে বলতে পারব না। তবে আমি ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ণ আকারে টুকে রাখছি, মানুষের জীবন আজকের দিনে ‘’বিগ নিউজ’ কিংবা ‘বিগ ইভেন্ট’-এর সাপেক্ষে বিচার করা হচ্ছে।
লেখক: ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক ইন চার্জ, বাংলা ট্রিবিউন