বাংলার দুর্যোগনামা এবং এবারের হাওর দুর্গতি

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীহিন্দু শাস্ত্রে আছে এ অঞ্চলের মানুষ হাঁটু জলে বাস করে আর তারা পক্ষী সদৃশ যাযাবর জাত। এতে মনে হয় বাংলাদেশের জনপথ গড়ে উঠেছিলো দুর্যোগের মধ্য দিয়েই। দুর্যোগের সঙ্গে জীবন-যাপন করতে বাংলাদেশের মানুষ অভ্যস্ত। টুঙ্গিপাড়ার মানুষ নাকি হাঁটু জলে টং বেঁধে বাস করতো তাই নাকি টুঙ্গিপাড়া নাম হয়েছে। বৃহত্তম ফরিদপুর জেলা তো ৪/৫ শত বছর হয় জেগে উঠেছে।
কুমারী মাটির জেলা বৃহত্তম ফরিদপুর। বরিশাল কিন্তু ফরিদপুরের চেয়ে প্রাচীন। প্রাচীনকালে বরিশালের নাম ছিল চন্দ্রদ্বীপ। ফরিদপুর জেলা জেগে ওঠার পর মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে চন্দ্রদ্বীপ সংযুক্ত হয়েছে। এখন আর কেউ চন্দ্রদ্বীপ নামে তাকে ডাকে না। এখন হচ্ছে বরিশাল বিভাগ। আইনে আকবরিতে আছে আকবরের সময়ে এ অঞ্চলের তুফান আর জলোচ্ছ্বাস হয়েছিলো। তা নাকি এত ভয়াবহ ছিল যে খড়দুর্বাও নাকি সোজা ছিল না।
গত শতাব্দীর ৬০, ৬৩ ও ৭০ সালেও বাংলাদেশের উপকূলে ভয়াবহ তুফান আর জলোচ্ছ্বাস হয়েছিলো। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলো। চট্টগ্রাম শহর পাহাড়ি অঞ্চল। কোতোয়ালী থানা আর সরকারি মুসলিম হাই স্কুল ‘মোল হিল’ এর মতো জায়গায় অবস্থিত। আমি ৬০ মালের তুফান আর জলোচ্ছ্বাসের পর কোতোয়ালী থানার গেটের সম্মুখে মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছি। এসব মৃতুদেহ কর্ণফুলী নদী দিয়ে ভেসে এসে ফিরিঙ্গি বাজার হয়ে সম্ভবতো কোতায়ালীর গেটে এসে ঠেকেছিলো। বলতে গেলে উপকূলের মানুষ দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। সম্ভবতো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন আরও ঘন ঘন আরও ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে। পায়ের নিচের মাটি তলিয়ে না গেলে দুর্যোগের সঙ্গে তারা যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকবে।

৪০ বছর আগেও বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যা হতো। আমার এলাকায় একটা বড় বিল আছে। গুমানমর্দ্দন বিল। প্রবীন কৃষকদের মুখে শুনেছি দীর্ঘ ২২ বছর নাকি বন্যার কারণে কাঁচি নিয়ে তাদেরকে বিলে যেতে হয়নি। তখন ইরি ধান করার ব্যবস্থাও ছিল না। প্রতি বছর ফসল মারা গেলে এলাকায় অবস্থা কী দাঁড়ায়। তখন দেখেছি অনাহার অর্ধাহার নিত্য সঙ্গী ছিল। লেংটি পরে বেটা ছেলেও লোকালয়ে বের হতো।

১৯৫৬ সালে যখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন তখন তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) বন্যানিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য নেদারল্যান্ডের ক্রুক সাহেবের নেতৃত্বে ক্রুক কমিশন গঠন করেছিলেন। পূর্ব-পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ক্রুক সাহেব সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করে একটা পরিকল্পনাও প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী সরকারের পতনের পর ৫৭ সাল থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত কোনও সরকারই আর ক্রুক কমিশনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনও উদ্যোগ নেয়নি। ক্রুক কমিশনের খরচ নির্ধারিত হয়েছিলো ৩৫০ কোটি টাকা। অথচ কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচি থেকে ইসলামাবাদ আর ইসলামাবাদ থেকে পিন্ডিতে স্থানান্তরিত করতে খরচ হয়েছিলো ১২ শত কোটি টাকা। বাঙালিরা কম দুঃখে ৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেনি।

হাওরের জেলা হচ্ছে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা আর কিশোরগঞ্জ। এবারের বন্যায় সুনামগঞ্জের ক্ষয় ক্ষতি ব্যাপক হলেও অবশিষ্ট তিন জেলায়ও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি। হাওরের মানুষকে হিদল সুটকীর ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে দেখেছি। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন তেমন হয়নি। ডিঙ্গাপোতার হাওরে গিয়েছিলাম একবার। প্রকাণ্ড হাওর এপার-ওপার বিস্তর ফারাক। মানুষের কাপড় ছোপড়ও খুবই সাধারণ গোচরের। হাওরের জমি এক ফসলা শুধু বোরো চাষ হয়। আর বোরো ধান দিয়েই চালাতে হয় সারা বছরের সংসার। মাছের চাষ হাঁসের চাষ সবই তলিয়ে গেছে। সব হাওরেই বাঁধ ভেঙে। কোনোটা আর অবশিষ্ট নেই। ব্যাপক ত্রাণের ব্যবস্থা না করলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নেমে আসবে অসহনীয় যন্ত্রণা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম যখন ক্ষমতায় আসেন তখন সমগ্র উত্তর বঙ্গব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী এক বন্যা হয়েছিলো। বন্যা এতো দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিলো যে ঘরের বেড়া পর্যন্ত পচে গিয়েছিলো। সে বন্যা ও বন্যা উত্তর পরিস্থিতি তিনি খুবই সফলতার সঙ্গে সামাল দিয়েছিলেন। এবারের ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা শুধু সুনামগঞ্জ। সুতরাং আমরা আশা করি যে প্রধানমন্ত্রীর এবারও খুবই যোগ্যতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন। আন্তর্জাতিক সাহায্যের কোনও প্রয়োজন হবে না। স্থানীয়ভাবে সবকিছুই মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। ত্রাণের কাজ স্থানীয় সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার চেয়ারম্যান দিয়ে পরিচালনা করলে অনেকে মনে করছেন আত্মসাতের সম্ভাবনা নাকি বেশি। পরিস্থিতি যদি অনুরূপ বলে মনে হলে সেনা বাহিনীর হাতে সব কাজ সোপর্দ করাই তো উত্তম হবে।

সরকার স্থানীয়ভাবে ডিলার নিযুক্ত করার কথা বলছেন- যারা সস্তা দামে চাল দেবেন। এ ব্যবস্থাটায় ব্যাপক কারচুপি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং সুষ্ঠু পথে ত্রাণ বিবতরণ ব্যবস্থাকে সঠিকও সক্রিয় রাখার জন্য সেনাবাহিনীর সহযোগিতাই নেওয়ার ব্যবস্থা করলেই মনে হয় সঠিকও উত্তমরূপে বিলি বণ্টন হবে। না হয় ১৫ দিনের মাঝেই নানা কাহিনিতে পরিস্থিতি বিষিয়ে উঠবে।

গতবার যারা বাঁধের কাজ করেছিলেন সেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারেরা নাকি ১৫ শতাংশ কাজ না করেই কাজ শেষ করেছেন আর শতাংশের বিল করেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বিশেষ করে যারা বাঁধের কাজ করান তাদের সততার কোনও সুনাম সুখ্যাতি নেই। ঠিকাদারদেরও একই অবস্থা। আমার এক বন্ধু তাদের আর কাস্টম ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের সততার কথা বলতে গিয়ে বললেন যে তাদেরকে নাকি ওজু করার জন্য বদনা ভর্তি পানি দিলে পানি খেয়ে বদনা বিক্রি করে চলে যায়। সততার অবস্থা যদি এতই ভয়াবহ হয় তবে তাদেরকে দিয়ে কাজ করানো তো নিরাপদ নয়।

১৯৫৬ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে এক ভয়াবহ বন্যা হয়েছিলো। আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায় আর মরহুম আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রী। সৌভাগ্য বশত কেন্দ্রীয় সরকারেও তখন সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী। উভয় সরকার বন্যা উত্তর পরিস্থিতিতে সারাদেশব্যাপী টেস্ট রিলিফের কাজ করালেন আর নদীবাঁধ নির্মাণ আর পূর্ণ-নির্মাণের কাজে সর্বশান্ত কৃষকেরা কাজ পেলেন। সেদিন অনাহারের হাত থেকে কৃষকেরা রক্ষা পেলো টেস্ট রিলিফের কাজের বিনিময়ে। আমার মনে হয় সুনামগঞ্জে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে টেস্ট রিলিফের কাজ আগামী সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করানো দরকার নগদ অর্থে সেনাবাহিনী কাজ করাবেন। কৃষকেরও কাজের অভাব, টাকার অভাব থাকবে না

বাঁধ পুননির্মাণের কাজও হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের অর্থ আত্মসাৎ থেকেও প্রকল্প বাঁচবে। একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি বাঁধের কাজে রোড রোলার মাটি বসানোর কাজে ব্যবহার করে না তাতে বাঁধের স্থায়িত্ব কম হয় পানির। স্রোতের বাঁধ ভেঙে যায় এখন থেকে বাঁধ নির্মাণের সময় রোড বোলার মাটি বসানোর কাজে ব্যবহার করার নিয়ম করে দিতে হবে। আর একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি বাঁধের প্রশস্ততা কম। অপ্রশস্ত বাঁধ স্রোতের তোড়ে তো ভাঙবেই। সুতরাং ভবিষ্যতে বাঁধের প্রশস্ততাও যেন বাড়ানো হয়।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com