এটা ঠিক, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ অনলাইনে। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই ছাপা পত্রিকা প্রতিদিনই অনলাইন পত্রিকার নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। আমরা যারা পুরনো ঘরানার মানুষ, তারা সকালে ঘুম ভেঙে ছাপা পত্রিকার পাতা না ওল্টালে নাস্তা খাওয়ার রুচি হয় না। কিন্তু এখনকার বাংলাদেশে অনেক মানুষকে চিনি যারা আর পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়েন না। জরুরি হলে রাতেই অনলাইনে পড়ে নেন। নইলে বেছে বেছে লিংকে ক্লিক করেন। তারা এখন আর একটি বা দু’টি নির্দিষ্ট পত্রিকার ওপর নির্ভর করেন না। হাতে থাকা স্মার্ট ডিভাইসে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন অনলাইন দেখেন। কোনো একটা নিউজের ব্যাপারে সন্দেহ হলে একাধিক পত্রিকা মিলিয়ে দেখেন। আমাদের মতো পুরনো ঘরানার লোকজন খুব বেশি দিন টিকবে না। নিউজের জন্য মানুষের অনলাইন নির্ভরতা দ্রুত বাড়ছে, আরও বাড়বে। অনলাইনের অনিবার্যতা বুঝতে ভুল হয়নি ছাপা পত্রিকাগুলোরও। বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো পত্রিকারই এখন অনলাইন ভার্সন আছে। কোনও কোনও পত্রিকার অনলাইন ভার্সনের পাঠক ছাপা পত্রিকার চেয়ে বেশি।
গণমাধ্যমের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং অনলাইনে ভালো সাংবাদিকতা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব, আমাদের স্বার্থেই। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে উল্টো ঘটনা। বাংলাদেশে এখন কয়টি অনলাইন আছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছেই নেই। মত প্রকাশ আর গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে অনলাইনের বিপুল বিস্তার ঘটেছে। ঘরে ঘরে অনলাইন- স্বামী প্রকাশক, স্ত্রী সম্পাদক; সাংবাদিক পরিবার। সেই ব্যাঙের ছাতামার্কা অনলাইন আর তার সাংবাদিকদের দাপটে টেকাই দায়। ইন্টারনেটের জগতে ঘুরে বেড়ায় সেইসব অনলাইনের লিংক। এমন চটকদার শিরোনাম, দেখলেই আপনার আঙুল নিশপিশ করবে ক্লিক করতে। কিন্তু ক্লিক করে দেখবেন ভেতরে আসলে কিছু নেই। আর হাতেগোনা গোটা দশেক অনলাইন ছাড়া বাংলাদেশের বাকি সব অনলাইন ক্লিকনির্ভর। তাদের চাই হিট, যে কোনো মূল্যে। আর এই হিটের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা। আপনাদের কৌতূহল হাতে পারে, দেশে হাজার হাজার অনলাইন চালানোর মতো এত সাংবাদিক আসে কোত্থেকে? ওই যে বললাম, গোটা ১০/১২ অনলাইন, এ কয়টা বাদ দিলে বেশির ভাগই চলে ভার্চুয়ালি। স্বামী প্রকাশক, স্ত্রী সম্পাদক। বাকি সব কন্ট্রোল সি, কন্ট্রোল ভি; কাট-পেস্ট। একসময় ফকিরাপুল থেকে অনেকগুলো আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা বেরুতো। একই ম্যাটার থাকতো সব পত্রিকায়। খালি ওপরের নামটা বদলে যেতো। আর ম্যাটারগুলো একটু ওলটপালট করে দেওয়া হতো। এই পত্রিকাগুলো শুধু ডিএফপিতে জমা দেয়া হতো। আর কিছু কপি যেতো সচিবালয়ের নির্দিষ্ট কিছু টেবিলে। ছাপা পত্রিকার দুর্দিনের সাথে সাথে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাতেও দুর্দিন চলছে। তবে আন্ডারগ্রাউন্ডের ভূত এখন ছাপা থেকে অনলাইনে ভর করেছে। আর প্রতিদিন পত্রিকা ছাপার চেয়ে একটা অনলাইন মেইনটেন করা অনেক সহজ, খরচও অনেক কম।
এখানেই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাংলা ট্রিবিউন। গত তিন বছরে পত্রিকাটি হিটের পেছনে ছোটেনি, ভালো সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করেছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কাট-পেস্টের ব্যাপারে বাংলা ট্রিবিউনে জিরো টলারেন্স। চার বছরে পা দেওয়ার এই ক্ষণে বাংলা ট্রিবিউনকে ধন্যবাদ। আশা করি শত প্রলোভনেও তারা হিটের ফাঁদে পা দেবে না। অটল থাকবে সুসাংবাদিকতায়। অটল থাকবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদার, অসাম্প্রদায়িক, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার আদর্শে।
লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ