‘ধর্ষণ’ মাত্র তিন অক্ষরের একটি শব্দ কিন্তু কী বিভৎস ব্যাপকতা এই শব্দটির। এ হলো ভয়, শঙ্কা, আতঙ্ক, লজ্জা, ঘৃণা, অসহায়ত্ব আর নির্মমতার এক ভয়ঙ্কর সমন্বয়তার নাম। একটি নারীর জন্ম মুহূর্ত থেকেই তার পরিবার আর সমাজ তাকে শেখাতে থাকে এই ঘটনা যদি ঘটেও তবু তা প্রকাশ হতে নেই, এটি লজ্জার, এটি একান্তই গোপন। সামান্যতম ত্রুটি না থাকা সত্ত্বেও এর সব দায়ভার আর গ্লানি কেবলই মেয়েটির। যে কয়টি ঘটনা সামনে আসে, প্রকাশিত হয় আর আলোড়িত করে গোটা সমাজকে, প্রকৃত ঘটনা ঘটে তার কয়েক গুণ বেশি। শিশুকাল থেকেই সকল কিছু ঢেকে রাখার যে চিরাচরিত শিক্ষা মেয়েটি পেয়ে আসে প্রথমেই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সেটি। কোনও ক্রমে মনের সাথে যুদ্ধ করে সেই বাঁধা যদি পেরোনোও যায় তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামনে এসে দাঁড়ায় তার পরিবার। পরিবারের সম্মান, মেয়েটির ভবিষ্যত এমন কী পরিবারের অন্য সদস্যদের ভবিষ্যত চিন্তাও মেয়েটিকে বাধ্য করে ঘটনাটি চেপে যেতে। এই তীব্র কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আর রাষ্ট্রের জাঁতাকলে বারংবার ধর্ষণের শিকার হতে থাকে মেয়েটি। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত অথচ গভীর গোপন ক্ষত জীবনভর বয়ে বেড়ায় সে।
বড় অদ্ভুত সমাজে বাস আমাদের, বড় আজব মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠি আমরা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র কোনোটিই তো বিচ্ছিন্ন নয়। ব্যক্তির মানসিকতাই ধারণ করে সমাজ বা রাষ্ট্র। এই মানসিকতারই প্রতিফলন ঘটে আইন, আদালত কিংবা বিচার ব্যবস্থায়। সমাজ, রাষ্ট্র বা বিচারব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক কারণ আমাদের মানসিকতা পুরুষতান্ত্রিক। তাই এ ধরনের ঘটনায় আমরা অবলীলায় সর্বশক্তি নিয়ে নির্লজ্জ হয়ে ওঠি মেয়েটিকে দোষী প্রমাণে। তার পোশাক, তার রূপ, তার বয়স, তার শিক্ষা, তার ঘরের বাইরে কাজ করা, একটি টিউশনি বা কোনও জন্মদিনের উৎসবে যোগ দেওয়া এর সবকিছুই দায়ী মেয়েটির ধর্ষণের শিকার হওয়ার পেছনে, দায়ী নয় কেবলমাত্র মানুষরূপি ধর্ষক পুরুষটি। আমরা ভুলে যাই হেজাবে জড়ানো মেয়ে ধর্ষিত হয়, ধর্ষিত হয় পাঁচ বছরের শিশু, অসহায় কিশোরী গৃহকর্মী, পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল পোশাকশিল্প কর্মী বা দোকানে কাজ করা গারো তরুণী কাজ শেষে ঘরে ফেরার পথে ।
'কিন্তু', 'যদি', 'যেহেতু', 'আসলে' ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে ধর্ষণকে জায়েজ করার চেষ্টা করা প্রতিটি নর-নারী আসলে সুযোগের অপেক্ষায় থাকা এক একজন ধর্ষক। যে কারণে মামলা দায়ের করতে গেলে পুলিশ একই অশ্লিল প্রশ্ন বারংবার করতে থাকে, ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জানতে ব্যাকুল হয়, বাদিকে দুশ্চরিত্র প্রমাণের এক ধরনের চেষ্টা থাকে, সৌভাগ্যবতী হলে ৪৮ ঘণ্টা পর হলেও মামলা দায়ের হয়, ধর্ষণের শিকার নারীকে শুধুমাত্র একটি এজাহার লেখাতে এক রাতে ঘুরতে হয় তিনটি থানা অথচ ওসি'র বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, অতি ভাগ্যবতী কেউ যদি মামলা দায়েরে সমর্থও হয় আদালতে আসামি পক্ষের আইনজীবী তাকে দুশ্চরিত্র প্রমাণে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়। প্রতিটি ধাপের এই বিভীষিকা বারবার একই কায়দায় বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত করে মেয়েটিকে।
একশ্রেণির মানুষ এখনই প্রশ্ন তুলবে যে ইউরোপ, আমেরিকার মতো দেশে কি এই অপরাধ হয় না? হয়, নিশ্চয়ই হয়। কিন্তু সেখানে প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয়, বিচার হয়, মামলা দায়ের করতে গিয়ে বা মামলা চালাতে গিয়ে আর একবার ধর্ষণের মুখামুখি হতে হয় না মেয়েটিকে, কেউ প্রথমেই আঙুল তোলে না মেয়েটির চরিত্রে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা জানে এটি একটি জঘন্য ফৌজদারি অপরাধ যার বিচার আর দশটি ফৌজদারি অপরাধের মতই আইন মোতাবেক হবে। এর সাথে নির্দোষ মেয়েটি বা তার পরিবারের সম্মান, চরিত্র, ভবিষ্যত কোনটিই জড়িত নয়। আর সব জঘন্য অপরাধের মতই এই অপরাধের ক্ষেত্রেও সম্মান বা ইজ্জত যদি কারও যাবার হয় তাহলে তা আসামির ও তার পরিবারের, অপরাধের শিকার মেয়েটির নয়, কিছুতেই নয়।
লেখক: আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ