রাজনীতির আগুনে, মানুষের সংকীর্ণতা ও লোভের আগুনে কিছুদিন পর পর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর, সংখ্যালঘু মানুষজনের বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ পুড়িয়ে দেওয়া হবে, এমনকি এই নিরীহ মানুষগুলোকে পুড়িয়ে মারা হবে, আর আমরা উন্নত রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে চলছি বলে ঢক্কানিনাদ বাজাব, এর চেয়ে প্রহসন আর কী হতে পারে! ধিক এই সর্বনাশা উন্নয়ন, ধিক এই আত্মঘাতী রাজনীতি!
শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে, কোনও মৃত্যু, কোনও অন্যায়ই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না, তা সে যে উদ্দেশ্যে, যে কারণেই ঘটুক না কেন! পার্বত্য চট্রগ্রামের লংগদুতে যে যে যুবলীগ নেতার মৃত্যু হয়েছে, তা কোনও মতেই মেনে নেওয়া যায় না। এই মুত্যুর কারণ অবশ্যই খুঁজে বের করা উচিত। যদি কোনও আদিবাসী এই হত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকে তবে অবশ্যই তার যথাযথ বিচার ও শাস্তি হওয়া উচিত। কারণ কোনও অন্যায়ের প্রতিবিধান যেমন নাগরিকরা নিজের হাতে করতে পারে না। কাউকে হত্যাও করতে পারে না।
কিন্তু একটি মৃত্যুর ঘটনাকে পুঁজি করে, কোনও সাক্ষী-প্রমাণ ছাড়া কেবল অনুমানের বশবর্তী হয়ে একটি জনগোষ্ঠীর ওপর সব দায় চাপিয়ে দেওয়া, তার পর হিংসা আর ক্ষোভের আগুনে ছড়িয়ে পুরো গ্রামের মানুষজনের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, এমনকি জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা, এ কোন রীতি? কেন এই আদিম হিংস্রতাকে উস্কে দেওয়া হচ্ছে? এ কোন সমাজ, কিসের সমাজ? কোথায় আইন, কোথায় আইনের শাসন? কোথায় সরকার?
এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। মিথ্যে একটা অভিযোগ তুলে কোনও একটা গুজব রটিয়ে দিয়ে বা বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মানুষকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা চর্চা, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বাড়িঘরে হামলা, আগুন দিয়ে ব্যাপক ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা। গত কয়েক বছর ধরে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্রগ্রামে এই কাজটি করা হয় সবচেয়ে বেশি।
গত শুক্রবার রাঙামাটির লংগদুতে যে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে তা আমাদের বিবেককেই যেন গলা টিপে ধরছে! প্রায় তিনশ আদিবাসী পরিবারের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আতঙ্কিত মানুষজন জীবনের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে একদল মানুষ আরেকদল মানুষের ওপর শ্বাপদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর তারা স্রেফ জীবন বাঁচাতে বাড়িঘর সহায়-সম্পদ ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাচ্ছে! হ্যাঁ, এটাই হচ্ছে আমাদের একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের চিত্র! এমন দেশ নিয়ে আমরা উন্নয়নের কোন চুলায় যাবো?
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার (১ জুন) লংগদু উপজেলা থেকে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক ও স্থানীয় সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন দুইজন যাত্রী নিয়ে দীঘিনালার দিকে রওয়ানা হন। দুপুরের পর দীঘিনালার চার মাইল এলাকায় তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পরে সন্ধ্যায় ফেসবুকে তার মৃতদেহের ছবি দেখে শনাক্ত করে পরিবার ও বন্ধুরা।
ওই যুবলীগ নেতাকে পাহাড়িরা হত্যা করেছে এমন অভিযোগ ওঠার পর সংগঠনের উত্তেজিত নেতাকর্মীরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। শুক্রবার সকালে হাজার হাজার সেটেলার আওয়ামী লীগের ব্যানারে একত্র হয়ে মিছিল বের করেছে। এই মিছিল থেকে হামলা চালিয়ে লংগদু সদরের তিনটিলা ও মানিকজুরছড়ায় পাহাড়িদের শত শত বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুরো এলাকা আতঙ্কপুরীতে পরিণত হওয়ার পর অবশেষে বেলা ১২টার দিকে ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে উপজেলা প্রশাসন।
শুক্রবার সকালে এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা আগে থেকেই অনুমান করা হয়েছিল। পাহাড়িদের অনেকেই প্রশাসনের কাছে তাদের নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়েছিলেনও। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা নাকি তাদের অভয়ও দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন সত্যি সত্যি এই হামলার ঘটনা ঘটে, তখন প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে। প্রশাসনের এই ভূমিকা খুবই দুঃখজনক।
অবশ্য পার্বত্য চট্রগ্রামে এমন ঘটনার ‘আলাদা মানে’ আছে। ভিন্ন মনস্তত্ব আছে। ওখানে যে সব সেটেলার আছে, তাদের, প্রশাসন ও সেনাকর্মকর্তাদের মনস্তত্ব সব সময় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মনস্তত্বের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। এক-আধটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে সেটেলার, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সেনারা সব সময় আদিবাসীদের শত্রু মনে করে। ওরা সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, উগ্র, ভিন দেশের এজেন্ট, বাঙালিদের বিরুদ্ধ শক্তি-এমন একটা ভাবধারা নিয়ে চলে। তাইতো যখনই কোনও সুযোগ আসে পাহাড়িদের জব্দ করার, তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার, সবাই একযোগে সেই সুযোগটা গ্রহণ করে।
তাইতো যুগের পর যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানকে একটা ‘ভিন্ন দেশ’ বানিয়ে রাখা হয়েছে। যেখানে পুলিশ-র্যাবের পাশাপাশি হাজার হাজার সেনাকেও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পাহাড়িদের নামে যে কোনও রকম একটা অভিযোগ খাড়া করে যা খুশি তাই করা যায়। এদের ধরে এনে নির্যাতন করা যায়। আগুনে পুড়িয়ে মারা যায়। শত শত বাড়িঘর আগুনে ভষ্মীভূত করে দেওয়া যায়। তাদের অপহরণ করা যায়। ধর্ষণ করা যায়। পাহাড়িদের অপমান, নির্যাতন-খুন হত্যা ধর্ষণ করলে কোনও বিচার হয় না। আইন ও আইনের শাসন সেখানে নীরব। প্রশাসন উদাসীন। সরকার বধির।
এখানে এমনই এক মেকানিজম তৈরি করা হয়েছে যে আদিবাসীদের হত্যা, ধর্ষণ, গ্রেফতার, হয়রানি, সেনা হেফাজতে শারীরিক অত্যাচার, সামরিক কর্মকর্তা ও সেটলারদের ভূমি দখলের বেশিরভাগ খবর কখনোই মিডিয়ায় আসে না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মিডিয়ার ‘ব্ল্যাক আউট’ এবং ‘সেন্সরশিপ’-এর অন্ধকারে পাহাড়ের খবরগুলো কখনোই আলো দেখা পায় না।
পার্বত্য চট্রগ্রামে যা হয়েছে, যা হচ্ছে, এর প্রতিবিধান হওয়া দরকার। একজন যুবলীগ কর্মীর মৃত্যুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যা করা হলো, তা রীতিমতো আদিম উন্মত্ততা। সন্ত্রাস। জুলুম। যে আদিবাসী বৃদ্ধাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো, কী জবাব দেবেন ক্ষমতাসীনরা এই মৃত্যুর? সরকারের, সরকারি দলের কাজ তো রক্ষা করা, হামলা করা নয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে তারা কী জবাব দেবেন? পাহাড়িদের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ থাকে, তাহলে তো আইন আছে, আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু সরকারি দলের কর্মীরা যদি নিজেরাই আইন হাতে তুলে নেন, তাহলে থানা-পুলিশ-সেনাদের ভূমিকা কী? সরকার এর জবাব কী দেবে? নাকি, সরকার হেফাজতি-মৌলবাদী চক্রের স্বার্থ ছাড়া আর কারও স্বার্থ দেখবে না বলে পণ করেছে? যদি তাই হয়, সেটাও স্পষ্ট করে বলা উচিত।
প্রত্যেক বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ওপর হামলা চলে, পুড়িয়ে দেওয়া হয় আদিবাসীদের বাড়িঘর-মন্দির। আদিবাসী মেয়েদের ধর্ষণ করে খুন করা হয়। জীবিত থাকলে রাষ্ট্রের চাপে ধর্ষণের রিপোর্ট দেওয়া হয় নেগেটিভ! পাহাড়ে পরিকল্পিতভাবে বাঙালিদেরকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিলো যেন এখন সেখানে আদিবাসীরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। সেই উদ্দেশ্য এখন সফল পুরোপুরি। পাহাড়ে এখন সেটেলাররা সংখ্যাগুরু আর আদিবাসীরা সংখ্যালঘু! এখন পাহাড়ে এলাকার নাম হয় বাঙালিদের নামে নামে যেমন- সুখী নীলগঞ্জ! অহলক্ষ্যাডং এর নাম পাল্টে সেখানে হয়ে গেছে ‘আলী কদম’! গ্রামের নাম রাখা হয় পাকিস্তানি ধরনের যেমন ‘মোহাম্মদপুর’। কী চমৎকার আদিবাসীদের বাঙালি বানানোর প্রক্রিয়া!
যদি কোনও আদিবাসী ছেলেমেয়ে প্রতিবাদ করে, নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন হয় তাদেরকে নানা রাজনৈতিক মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়। এর আগে ১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছিল। এখনো তার হদিস মেলেনি। গেলো মাসে নির্যাতন চালিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো রোমেল চাকমাকে। এই ধারা নিয়মিত চলছে।
পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের ওপর যত উপায়ে নির্যাতন আর আগ্রাসন চালানো হতো বর্তমানে তার কোনও উপায় কি আদিবাসীদের ওপর বাদ যাচ্ছে? অথচ সময় গড়িয়ে ১৯৭১ সাল থেকে ২০১৭! আর আমরা বাঙালিদের একটা বড় অংশ এখনও এই নির্যাতনকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে চলেছি তথাকথিত দেশপ্রেম আর উগ্র জাতীয়তাবাদের মোহে অন্ধ হয়ে।
লেখক: কলামিস্ট