পাপ বাপকেও ছাড়ে না

প্রভাষ আমিনরবিবার রাতে এক বন্ধু ফেসবুক মেসেঞ্জারে ইনবক্সে জানতে চাইলেন, সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণের দাম কত?
আমি বললাম, শুনেছিলাম, ভুলে গেছি।
আসলে আমাদের মধ্যবিত্তের ভাবনার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। ১০০ হাজারে এক লাখ, এটুকু মনে রাখতে পারি। লাখ লাখ, কোটি কোটি, হাজার কোটি শুনলেই প্যাচ লেগে যায়; পেছন থেকে গুনতে থাকি- একক, দশক, শতক...। মনে রাখতে পারি না।
সারাজীবন স্বর্ণের ওজন শুনে এসেছি ভরিতে। এখন এক ভরি স্বর্ণের দাম কত? কয় ভরিতে এক কেজি হয়? দুইটা গুণ দিলে এক কেজির দাম বের হবে। তাকে ৪০ দিয়ে গুণ দিলে এক মণের দাম পাবেন। তাকে ১৩.৫ দিয়ে গুণ দিলেই পেয়ে যাবেন সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণের দাম। আমার সমস্যা হলো, এক ভরি স্বর্ণের এখনকার দাম কত তাও জানি না, আর কয় ভরিতে এক কেজি হয় তাও জানি না। আপনারা কেউ বের করতে পারলে জানাতে পারেন। খালি অনুরোধ, হিসাব করার সময় বড় ক্যালকুলেটর নিয়ে বসতে হবে। ছোট খাটো ক্যালকুলেটরে অত টাকার হিসাব নাও আসতে পারে।
সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণের দাম নয়, আমার মাথায় খালি ভাবনা, সাফাতের মতো একটা ছেলে থাকলে, আর কিছু লাগে না। আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিম সারাজীবন ব্যবসা করে মণ কে মণ স্বর্ণ কামালেন, এক ছেলের জন্য একলহমায় তার সব তামা হয়ে গেলো। সারাজীবনের সব কামাই এখন বাংলাদেশে ব্যাংকের ভল্টে। এই ঘটনায় দায় যতটা সাফাতের, তারচেয়ে বেশি তার বাবা দিলদারের। ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আসার পরও দিলদার তার পক্ষে সাফাই গাইছিলেন। আমার আসলে দিলদারের জন্য করুণা হচ্ছে। তার হয়তো শত কোটি বা হাজার কোটি টাকা আছে। কিন্তু দিলদার তার আসল সম্পদ চিনতে পারেননি। আসল সম্পদ আপনার সন্তান। দিলদার যদি স্বর্ণে বিনিয়োগ না করে, সন্তানে বিনিয়োগ করতেন, তাহলে আজ তাকে এমন পথে বসতে হতো না। পথে বসাটা হয়তো আক্ষরিক অর্থে নয়। সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণ জব্দ করার পরও হয়তো দিলদারের আরো অনেক সম্পত্তি আছে। কিন্তু ভাবুন একবার, যার সন্তান ধর্ষণের অভিযোগে কারাগারে থাকে, তারচেয়ে নিঃস্ব আর কে আছে? অনেকেই বলছেন, দিলদারের ছেলে সাফাত আহমেদের বিরুদ্ধে না হয় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। কিন্তু যে অভিযোগে তার সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণ জব্দ করা হলো, একই অপরাধ তো বাংলাদেশের সব স্বর্ণ ব্যবসায়ীই করেন এবং করছেন। কারণ বিমানবন্দর ছাড়া বাংলাদেশে কোনও স্বর্ণের খনি নেই। কিছুদিন পরপরই বিমানবন্দরে মণে মণে স্বর্ণ ধরা পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি হয় না বললেই চলে। তাহলে এত এত স্বর্ণের দোকান স্বর্ণ পায় কই। আসলে বাংলাদেশে স্বর্ণের ব্যবসার পুরোটাই চলে চোরাচালানে আসা স্বর্ণ দিয়ে। আপন জুয়েলার্সের মতো কোনও জুয়েলার্সই তার স্বর্ণের বৈধ কাগজ দেখাতে পারবে না। এটা ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে। কিন্তু সরকার দেখেও না দেখার ভাব করছে। তাহলে আপন জুয়েলার্সকে ধরা হলো কেন? ওই যে কথায় বলে না, পাপ বাপকেও ছাড়ে না।
তবে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আপন জুয়েলার্সের জব্দ করা সব স্বর্ণ ফেরত না দিলে রোববার থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের হুমকি দিয়েছে। হুমকি শুনে আমার মনে হয়েছে, চোরের সাক্ষী মাতাল। আপন জুয়েলার্সের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের পাশে কিভাবে দাঁড়ায় সমিতি। আমার ধারণা ব্যবসায়ীরা আসলে তাদের নিজেদের স্বর্ণ বাঁচাতেই এই দাবি জানিয়েছেন। ধর্মঘটের আড়ালে তাদের মূল দাবি আসলে আর কোনও জুয়েলার্সে যেন এ ধরনের অভিযান চালানো না হয়।
দিলদার আহমেদ সেলিমের ঘটনা থেকে আমাদের কিছু শেখার আছে? আমরা কি বুঝবো আমাদের আসল সম্পদ কোনটা, সন্তান না স্বর্ণ? টাকা থাকলেই কি আমরা সন্তানকে প্রতিদিন দুই লাখ টাকা পকেট খরচ দেবো লুচ্চামি করার জন্য? দিলদার আহমেদ সেলিমের অনেক টাকা। কিন্তু বিল গেটসের চেয়ে বেশি নিশ্চয়ই নয়। বিল গেটস প্রতিদিন তার সন্তানদের কোটি টাকা পকেট খরচ দিলেও তার অর্থ ফুরাবে না। বিশ্বের সেরা ধনী বিল গেটস অনেক অর্থ কামিয়েছেন, তাই জানেন অর্থই অনর্থের মূল। বিল গেটসের সন্তানরা একটা নির্দিষ্ট বয়সের আগে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগও পান না। অঢেল ও বেহিসেবী অর্থ সাফাতকে যেমন অমানুষ বানিয়েছে, এর আগে ঐশীকেও খুনি বানিয়েছিল।
একজন মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে। আর সেই কর্ম ধারণ করে বাবা-মাকে বাঁচিয়ে রাখে তার সন্তান। তাই বুদ্ধিমানরা মূল বিনিয়োগটা করেন সন্তানে। অনেকে সন্তানের জন্য গাড়ি-বাড়ি-ব্যাংক ব্যালেন্স রেখে যেতে প্রাণান্ত পরিশ্রম করেন। আর বাপের টাকা ধ্বংস করে অপোগন্ড সন্তান। তারচেয়ে ভালো আপনি যদি আপনার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করেন, সে নিজেই তার জীবনধারনের মতো অর্থ উপার্জন করতে পারবে, আপনার রেখে যাওয়া সম্পদের দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনটা ধ্বংস করবে না। ভেবে দেখুন, আপনি যে কঠোর পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, সেটা ভালো, নাকি আপনার বাবার টাকায় ফুটানি করলে ভালো লাগতো? অবশ্যই সন্তানের পেছনেই আপনি আপনার সমস্ত আয় ব্যয় করবেন। তাকে ভালো স্কুলে পড়াবেন, ভালো পোশাক পড়তে দেবেন, ভালো ডাক্তার দেখাবেন, সন্তানের সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু খেয়াল রাখবেন, আপনার সন্তান যেন অপচয় না করে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ যেন সে হাতে না পায়। কিপটেমি করবেন না, সন্তানের হাতে দেওয়া প্রতিটি পয়সার হিসাব যেন আপনার জানা থাকে। আপনার সন্তান যেন আপনার অর্থেই মাদক নিতে না পারে, নারীদের পেছনে ব্যয় করতে না পারে। সেটা খেয়াল রাখার দায়িত্ব আপনারই। আপনার সন্তান যেন নারীদের শ্রদ্ধা করে, আপনার সন্তান যেন জীবনকে ভালোবাসে, আপনার সন্তান যেন মানবিক মানুষ হয়; সেটুকু নিশ্চিত করতে পারলেই আপনি সফল। নইলে আপনার সারাজীবনের সব অর্জন ধুলোয় মিশে যাবে দিলদারের মতো।
বনানীকাণ্ড থেকে আমাদের আরও অনেককিছু শেখার আছে। একটা হলো, কার সাথে ছবি তুলবেন, কার সাথে তুলবেন না। বনানীকাণ্ডের পর সেলফি মানেই আতঙ্ক। কার সাথে ছবি তুলবেন, কার সাথে তুলবেন না; এটা অবশ্য পুরোপুরি আপনার ওপর নির্ভর করে না। মোবাইলের যুগে এখন বাংলাদেশে ১৬ কোটি ফটোগ্রাফার। সবার হাতেই ডুয়েল ক্যামেরা। যখন তখন ছবি তোলা এখন ডালভাত। বিশেষ করে সেলিব্রেটিদের জন্য এই ক্যামেরা হলো শাখের করাত। আপনি যদি সেলফি তুলতে রাজি না হন, সবাই বলবে ভাব বেড়ে গেছে। আর যদি নির্বিচারে ছবি তোলেন, তাহলে কী হতে পারে, বনানীকাণ্ডের পর সবাই এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।

ঢাকায় এসে নাঈম আশরাফ বনে যাওয়া সিরাজগঞ্জের হালিম একজন পেশাদার টাউট। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ব্যবসা তার সাইনবোর্ড, আসল ব্যবসা প্রভাবশালীদের সাথে সেলফি তুলে তা ফেসবুকে দিয়ে বোঝানো সেও কতটা ক্ষমতাশালী। তারপর সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা সুবিধা আদায়ই হলো তার মূল ব্যবসা। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টও এই প্রক্রিয়ার অংশ। অবশ্য এই প্রবণতা নতুন নয়। যখন হাতে হাতে মোবাইল ছিল না, তখনও এ ধরনের কিছু মানুষ প্রভাবশালীদের সাথে ছবি তুলে বাসার ড্রইংরুমে সাজিয়ে রাখতো। মোবাইল, ফেসবুক আসার পর এ ধরনের মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, তাদের সুযোগ নেওয়ার সুবিধাও বেড়েছে। টেলিভিশনে কোনও নেতা বক্তব্য রাখার সময় পেছনে ক্যামেরার ফ্রেমে থাকার জন্য কিছু মানুষের ধাক্কাধাক্কি দেখি। আমরাও মাঝে মাঝেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা কোনও মন্ত্রীর পেছনে দাঁড়ানো মানুষদের কাউকে চিহ্নিত করে নিউজ করি, দাগী আসামীর সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বা অন্য কোনও মন্ত্রীর কোনও দোষ দেখি না আমি। মন্ত্রীরা তো আর সারাদেশের লাখ লাখ দাগী আসামীর নামের তালিকা পকেটে নিয়ে ঘোরেন না বা সবাইকে তারা চেনেনও না। কে, কখন, কোথায় ছবি তুললো; সেই ছবি দিয়ে সে কোথায় কোন ফায়দা আদায় করলো, তা তো আর তাদের মনিটর করা সম্ভব নয়। বনানীর ঘটনার পরও বিশেষ করে নাঈম আশরাফের সাথে মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতা, গায়িকা, নায়িকা, ক্রিকেটার, পুলিশ, সাংবাদিকদের ছবি বা সেলফি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এই ছবি দিয়ে অনেককে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়। নাঈম আশরাফের সাথে সেলফি আতঙ্কে ভুগছেন অনেকে। নাঈম হয়তো মন্ত্রীর সাথে তার সেলফি দেখিয়ে এমপির কাছ থেকে, এমপির ছবি দেখিয়ে পুলিশের কাছ থেকে সুবিধা নেয়। কিন্তু আমরা অযথাই যাদের সাথে ছবি, তাদের হেয় করছি। নাঈম যখন সুযোগ পেয়ে ছবি তুলেছে, তখন তো সে ধর্ষণ মামলার আসামী ছিল না। যারা ছবি তুলেছেন, তারাও জানতেন না, নাঈম পরে ধর্ষণ করবে। তবে তারপরও সেলিব্রেটিদের ছবি তোলার ব্যাপারে সাবধান থাকা উচিত। ভুবন জোড়া কত ফাঁদ পাতা থাকে, কে যে কখন, কোথায় সেই ফাঁদে পড়ে যায় কে জানে?
বিশ্ব জোড়া পাঠাশালা। আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। সাফাতের ঘটনায় তরুণদের, দিলদারের ঘটনায় অভিভাবকদের, নাঈমের ঘটনায় সেলিব্রেটিদের। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা হলো, আমরা কখনও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই না। তাই বারবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ