ইদানীং ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট ম্যাচকে কেন্দ্র করে যে তথাকথিত আবেগ দেখা যায়, তার মধ্যে নিখাদ ক্রীড়াপ্রীতি তথা বিনোদনপ্রীতি কতটুকু সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। বিষয়টির মধ্যে অন্য কিছু আছে, যা এখনও সমাজমনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সম্পূর্ণ আওতায় আসেনি। অনুমান চলতে পারে: এই ‘অন্য কিছু’টি এক রকম সামাজিক বিকার। নিজেদের বহুমাত্রিক হীনতা, ক্ষুদ্রতা ও ‘বিকৃতি’ প্রকাশের একটা তাড়না। ক্রিকেটের অজুহাতে দেশময় এক ধরনের বিকৃতি ও পাগলামির প্রবাহ!
এক অদ্ভূত ভারত-বিরোধিতা এখন বাংলাদেশে সর্বজনীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনেকে তো তিস্তার পানি-বঞ্চনার বদলা ওভাল ক্রিকেট মাঠে নেওয়ার আহ্বান জানায়। অনেকে তাতে ঘি ঢালে। কিছু দিন আগেও এতখানি ভাবা যেত না। ভারত ও হিন্দুবিদ্বেষ এখন আমাদের সমাজের, বিশেষত যুবসমাজের একটা বড় অংশের, প্রাত্যহিক চেতনার অংশ। ভারতের এগারো জন ক্রিকেটারকে এগারো জন জঙ্গির মতো ধ্বংস করা উচিত-এমন একটা মনোভাব অনেকেই দেখিয়ে থাকেন। এটা এখন আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এই সংস্কৃতি দেখে লজ্জায় ঘৃণায় শিউরে উঠবার মতো নাগরিক ক্রমে বিলুপ্ত প্রজাতির তালিকায়!
আর সোশ্যাল মিডিয়া এখন হুজুগ-গুজব-আর প্রপাগান্ডার সবচেয়ে কার্যকর মেশিন। অশালীনতার সংস্কৃতি এখানেই তার উর্বরতম ভূমিটি পেয়েছে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, সব বিষয়ে এখানে আক্রমণ ও হিংসাভাবের অবিশ্রান্ত প্রবাহ। এই আশ্চর্য গণতান্ত্রিক অপসংস্কৃতি যে কোনও বিষয়কেই দ্রুত হীনতার নিম্নতম স্তরে নামাতে পারে। হিংসাবাক্য-উচ্চারণকারী ব্যক্তিগণ পরস্পর-সংযুক্ত হয়ে ছোট থেকে বড়, বড় থেকে বৃহত্তর গোষ্ঠী রচনা করতে পারে। সুতরাং ভারতীয় ক্রিকেটাররা যে বাংলাদেশের নিধনযোগ্য শত্রু এবং ভারতীয়রা (মুসলিমরা বাদে!) যে ক্রিকেট থেকে শুরু করে সর্বত্রই বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও অকল্যাণকামী, বারংবার বলবার ফলে কথাটি বিশ্বাসযোগ্য ‘সত্যে’ পর্যবসিত হয়েছে!
খেলায় রাজনীতির কোনও স্থান নেই, এমন একটা কথা এক কালে খুব শোনা যেতো। সেই কালেও খেলার মধ্যে রাজনীতি ঢুকে পড়ত নিশ্চয়ই, তা না হলে কথাটা বলার দরকার হতো না। আজ আর ওই আপ্তবাক্যটি বিশেষ শুনি না। তার কারণ এই নয় যে, খেলা থেকে রাজনীতি দূর হয়েছে। ব্যাপারটা উল্টো-খেলায় রাজনীতির আসন পাকাপোক্ত এবং স্বীকৃত হয়েছে। সে খেলা যদি ভারত বনাম বাংলাদেশ ক্রিকেট ম্যাচ হয়, তবে সেটি আর আসন নয়, সিংহাসন। সেই খেলায় রাজনীতি ঢুকে পড়ে না, ঢুকে পড়ার কোনও উপায় নেই, কারণ খেলাটাই তখন রাজনীতি। যে রাজনীতির অন্য নাম: ঘৃণা বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা।
যারা মাঠে নামেন তারা এখনও, অন্তত সাধারণত, খেলাটাকে খেলা হিসেবেই নেন। সেটা কাণ্ডজ্ঞানের ব্যাপারও বটে-খেলার মধ্যে একটা স্বাভাবিক লড়াই থাকে, সর্বশক্তি এবং সমস্ত দক্ষতা দিয়ে সেই লড়াই লড়তে হয়, তাকে সত্যি সত্যি যুদ্ধ ভেবে বসলে খেলাটাই বরবাদ হয়ে যেতো। কিন্তু খেলেন তো মাত্র কজন। বাকিদের কোনও দায় নেই, এমনকি খেলাটা মন দিয়ে দেখারও দায় নেই। এই বিপুলসংখ্যক দায়হীন, গর্বিত বাংলাদেশের নাগরিকের একটা বৃহৎ থেকে বৃহত্তর অংশ ক্রমশই আপনবেগে পাগলপারা হয়ে উঠছেন, গালিগালাজে ও ব্যঙ্গবিদ্রূপে তারা শত্রুদের নিপাত করবেনই করবেন, যারা সেই অশ্লীল কুনাট্যে শামিল হতে চায় না তাদের তৎক্ষণাৎ দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেবেনই দেবেন। এই দেশপ্রেমী উন্মাদনা সোশ্যাল মিডিয়ার অনায়াস বাধাবন্ধহীন নিঃসীম পরিসরে সহস্রধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত খেলায় ভয়ানক হুঙ্কার ও ভয়ানকতর গালিগালাজের প্লাবন এখন আর শুধু বিরাট কোহলিতে গিয়ে থামছে না, ভারতের প্রতিও অকাতরে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। বুঝতে অসুবিধে হয় না, ক্রিকেট উপলক্ষমাত্র, এ হলো অতিজাতীয়তার মৌতাত। নেশা যত চড়বে, ভারতবিদ্বেষী রাজনীতি ততো পোক্ত হবে।
এ জিনিসের তাড়নায় খেলার কতটা ক্ষতি জানি না। খেলোয়াড়রা সুযোগ মতো খেলে যাচ্ছেন, যাবেনও। জয়-পরাজয় চলছে, চলবেও। কিন্তু রাজনীতির-সত্যিকারের রাজনীতির-খুব বড় ক্ষতি হচ্ছে, আরও হবে। ক্রিকেট উপলক্ষে সম্পূর্ণ অন্তঃসারশূন্য নানান মন্তব্যের যে বিস্ফোরণ এবং তার মধ্যে সম্পূর্ণ বিচারবিবেচনাহীন জঙ্গিয়ানার যে প্রতিফলন, সেটাই অধুনা রাজনৈতিক সচেতনতা হিসেবে বাজারে কাটছে। খেলা আসে, খেলা যায়, ওই বাজারের শোরগোল চলতেই থাকে। চায়ের দোকানের আড্ডা কিংবা পত্রপত্রিকার পৃষ্ঠা অধুনা কিঞ্চিৎ নিষ্প্রভ, এখন রক্ত গরম করতে চাইলে সন্ধ্যাবেলায় টেলিভিশন চ্যানেল আর অষ্টপ্রহর সোশ্যাল মিডিয়া। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সেই আসরে দুদণ্ড স্থির হয়ে ভেবে কিছু বলার জো নেই, বিভিন্ন মতামত বিচার করে মধ্যবর্তী কোনও অবস্থান নেওয়ার উপায় নেই, হয় তুমি ভারতীয়দের গালাগাল কর, না হলে তুমি দেশদ্রোহী, হয় তুমি ভারতকে শত্রু বলে মনে করো নচেৎ তুমি ভারতের দালাল। এই বুদ্ধিহীন আত্মরতিকে আর যা-ই হোক, রাজনীতি বলে না, সুস্থতাও বলে না।
অথচ সুস্থ রাজনীতির অনুশীলন এখন খুব দরকারি। ভারতের অনেক নীতি, বিশেষ করে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ভূমিকা ও অভিন্ন নদনদীর পানি-বণ্টন প্রশ্নে ভারতীয় সরকারের নীতি বাস্তবিকই আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী। এ জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আরও অনেক বেশি কূটনৈতিক উদ্যোগ দরকার। এ জন্য সরকারের ওপর চাপসৃষ্টিরও দরকার আছে। কিন্তু গালাগাল-চিৎকার আর ঘৃণা-বিদ্বেষ দিয়ে এই বিপদের মোকাবিলা করা যায় না, বরং তাতে জটিলতা বাড়ে। বাড়ছে। ভারতীয় ক্রিকেটারদের গালাগাল, অপমান করে আখেরে কোনও লাভ হতে পারে না।
ভারত বাংলাদেশ ক্রিকেট দ্বৈরথ মানেই এখন বাংলাদেশে জুড়ে একটা নতুন ভারতবিরোধী নকল যুদ্ধের মহড়া। এ ব্যাপারে অবশ্য কোনও কোনও ভারতীয় খেলোয়াড়েরও দায় আছে। যেমন এবার সেমিফাইনালে মুশফিক আউট হওয়ার পর ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলি যেভাবে জিহবা বের করে উল্লাস প্রকাশ করলেন, সেটা কতটা খেলোয়াড়সুলভ আচরণ-সে প্রশ্ন থেকেই যায়। কিন্তু একজনের হীন আচরণের জন্য তো আর সামষ্টিকভাবে হীন হওয়া চলে না। আমাদের দেশে এরপর যা হলো-তা আরও লজ্জার। ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল ম্যাচে ভারতের পরাজয়ে অনেককে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে ব্যাপক উল্লাস প্রকাশ করতেও দেখা গেলো। একটি সামান্য ক্রিকেট ম্যাচও এখানে বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতির প্রবল প্রস্তুতিতে পূর্ণ। বিনোদনও আপাদমস্তক রাজনৈতিক: নেতিবাচক রাজনীতির মঞ্চ!
পরিশেষে ক্রিকেট-উন্মাদনা বিষয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের সফল অধিনায়ক মাশরাফির বিন মুর্তজার উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করতে চাই।
‘দেশের তুলনায় ক্রিকেট অতি ক্ষুদ্র একটা ব্যাপার। একটা দেশের অনেক ছোট ছোট মাধ্যমের একটা হতে পারে খেলাধুলা; তার একটা অংশ ক্রিকেট। ক্রিকেট কখনও দেশপ্রেমের প্রতীক হতে পারে না। সোজা কথায়-খেলাধুলা হলো বিনোদন’।
‘খেলা কখনও একটা দেশের প্রধান আলোচনায় পরিণত হতে পারে না। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে যা সমাধান বাকি। সেখানে ক্রিকেট নিয়ে পুরো জাতি, রাষ্ট্র এভাবে এনগেজ হতে পারে না। ’
‘আমি ক্রিকেটার, একটা জীবন কি বাঁচাতে পারি? একজন ডাক্তার পারেন। কই, দেশের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের নামে কেউ তো একটা হাততালি দেয় না! তাদের নিয়ে মিথ তৈরি করুন, তারা আরও পাঁচজনের জীবন বাঁচাবেন। তারাই তারকা। তারকা হলেন লেবাররা, দেশ গড়ে ফেলছেন। ক্রিকেট দিয়ে আমরা কী বানাতে পারছি? একটা ইটও কি ক্রিকেট দিয়ে বানানো যায়? একটা ধান জন্মায় ক্রিকেট মাঠে? যারা ইট দিয়ে দালান বানায়, কারখানায় এটা-ওটা বানায় বা ক্ষেতে ধান জন্মায়, তারকা হলেন তারা’।
‘বীর হলেন মুক্তিযোদ্ধারা। আরে ভাই, তারা জীবন দিয়েছেন। জীবন যাবে জেনেই ফ্রন্টে গেছেন দেশের জন্য। আমরা কী করি? খুব বাজে ভাবে বলি--টাকা নেই, পারফর্ম করি। একটা অভিনেতা, গায়কের মতো পারফর্মিং আর্ট করি। এর চেয়ে এক ইঞ্চি বেশিও না। মুক্তিযোদ্ধারা গুলির সামনে এইজন্য দাঁড়ায় নাই যে জিতলে টাকা পাবে। কাদের সঙ্গে কাদের তুলনা রে!’
‘কিছু হলেই আমরা বলি, এই ১১ জন ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধি। আন্দাজে! তিন কোটি লোকও হয়ত খেলা দেখেন না। দেখলেও তাদের জীবন-মরণ খেলায় না। মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন রাজনীতিবিদেরা, তাদের স্বপ্ন ভবিষ্যত অন্য জায়গায়। এই ১১ জন মানুষের ওপর দেশের মানুষের ক্ষুধা, বেঁচে থাকা নির্ভর করে না। দেশের মানুষকে তাকিয়ে থকতে হবে একজন বিজ্ঞানী, একজন শিক্ষাবিদের দিকে!’
(মাশরাফি বিন মুর্তজার সাক্ষাৎকারভিত্তিক আত্মজীবনীমূলক বই ‘মাশরাফি’ থেকে, গ্রন্থনা: ক্রীড়া সাংবাদিক দেবব্রত মুখোপাধ্যায়)।
লেখক: কলামিস্ট