ঈদ রমজানে কী দেখলাম…

আনিস আলমগীরকালেমা, নামাজ, হজ, রোজা ও যাকাত ইসলামের মৌলিক এবাদত।  সারা এক মাসব্যাপী রোজা পালন করতে হয়।  আরবি রমজান মাসকে তাই বলা হয় সিয়াম সাধনার মাস।  সংখ্যায় কম বেশ হলেও ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমান- এই তিন কিতাবি ধর্মেই উপবাস প্রথার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।  মুসলমানেরাই সবচেয়ে বেশি সময়, এক পূর্ণ চন্দ্রমাস, রোজা পালন করে থাকে।
গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশে রমজান মাসে ইফতার সংস্কৃতি চালু হয়েছে।  এই সংস্কৃতি চালুর মূল হোতা দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।  ইফতারে এই দুই দল কোনও ধর্মীয় কথা বলে না, তারা রাজনীতির চর্চাই করে বেশি।
অবশ্য রাজনৈতিক দল রাজনীতির চর্চা করা স্বাভাবিক।  মহাত্মা গান্ধী বিড়ালা মন্দিরে সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনা সভা করতেন।  মনে হতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান।  অথচ ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামই পরিচালনা করেছেন তিনি এই প্রার্থনা সভার মাধ্যমে।  ১৯৪৮ সালে এই প্রার্থনা সভাতেই নাথুরামের গুলিতে তার মৃত্যু হয়েছে। 

বাংলাদেশেও এখন ইফতারের এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক চর্চার প্রথা চালু হয়েছে ব্যাপকভাবে।  রমজান আর ঈদ মওসুমকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছে ভালোভাবে।

বাজার অর্থনীতির সুবাদে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাঠের তীব্রতা এখন আগের মতো নেই।  এমনকি আগে যে প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে জনসভা হতো তাও এখন হয় না।  পত্রিকায় প্রেস রিলিজ দিয়েই জনসভা ডাকা হয়।  এটা মূলত ‘রেন্ট এ ক্রাউড’ এর মতো।  ট্রাকে বাসে লঞ্চে মানুষ এনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত করে বক্তৃতার পর তাদেরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। 

দুই বৃহৎ দল রাজনীতির এই সংস্কৃতি চালু করার পর ছোট দলগুলোর বিকাশ প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে।  সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সভা করার সার্মথ্য তাদের নেই, বড় দল দুটির এক জনসভাতেই খরচ হয় ৩/৪ কোটি টাকা। ছোট দলগুলোর জন্য এখন প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধই সম্বল।

জিয়াউর রহমানের সময়ে জিপিওর পাশের চিপা জায়গায় মুক্তাঙ্গন তৈরি করা হয়েছিল জনসভার জন্য, যাকে লোকে বিদ্রুপ করে বলতো লন্ডনের হাইড পার্ক।  জিয়ার আগে জনসভার মাঠ ছিল পল্টনের ময়দান।  এখন জিয়ার মুক্তাঙ্গনও নেই।  রেন্ট এ কারওয়ালা সে জায়গা দখলে নিয়েছে এখন।

ছোট দল ও সংগঠনগুলোকে বিনা পয়সায় জনসভা স্বার্থে মুক্তাঙ্গন মুক্ত করে দেওয়া দরকার।  দিল্লির রাম লীলা ময়দানে স্থায়ী মঞ্চ রয়েছে। গণতন্ত্রের চর্চার জন্য এমন সহায়তার প্রয়োজন।  গণতন্ত্রের নামে রাস্তায় সভা করার দরকার নেই, গাড়ি ভাঙার দরকার নেই।  রাস্তায় পিটুনি খাওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না।

এবারের ইফতার পার্টিগুলোতে দুই বৃহৎ দলই জাতিকে রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছে।  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইফতার পার্টিসহ বিভিন্ন দলীয় অনুষ্ঠানে বেগম জিয়াকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।  আবার বেগম জিয়া এক ইফতার পার্টিতে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘জনগণ সব হিসাব রাখছে।  এদেরকেও ওই এক কাপড়ে বাড়ি-ঘর থেকে বিদায় করে দেবে। ’ 

খালেদা জিয়া এটা কী করে বলেন! জনগণ  কিংবা ক্ষমতায় গেলে তিনি কী করে শেখ হাসিনাকে এক কাপড়ে বের করবেন! সুধা সদন তো সরকারি সম্পত্তি নয়, মওদুদের খাড়া দলিলের সম্পত্তিও নয়।  আমাদের রাজনীতিবিদদের আকাঙ্ক্ষা দেখে লজ্জিত হতে হয়- কারও ক্যান্টনমেন্টের একশ ৬২ কাঠা জমির বাড়ি লাগবে, কারও গণভবন লাগবে!

অথচ পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি থাকতেন তার ভাতিজার ফ্ল্যাটে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থাকতের স্ত্রীর ফ্ল্যাটে।  ১৯৭৭ সালে সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরে এক ভাড়া ফ্ল্যাট বাড়িতে উঠেছিলেন।  ইন্দিরার কোনও বাড়ি ছিল না দিল্লিতে।  মোরারজি দেশাইয়ের কোনও বাড়ি ছিল না দিল্লিতে, ক্ষমতা হারিয়ে মুম্বাইয়ের নিজ বাড়িতে চলে গেছেন।  ভারতের জাঠ সম্প্রদায়ের প্রখ্যাত নেতা চৌধুরী চরণ সিংও প্রধানমন্ত্রীত্ব হারিয়ে হরিয়ানা চলে গিয়েছিলেন কারণ দিল্লিতে তার কোনও বাড়ি ছিল না।  ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী হ্যারোল্ড উইলসন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন লন্ডনের ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়ি ছাড়ার পর ২৫০ কিলোমিটার দূরে তার গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন কারণ লন্ডন শহরে তার বাড়ি ছিল না।

জেনারেল কাউলের আনটোল্ড হিস্ট্রি বইতে পড়েছিলাম তিনি ভারতীয় মিলিটারি থেকে অবসর নেওয়ার পর একটা আশ্রমে উঠেছিলেন।  এতো লম্বা ফিরিস্তি দিচ্ছি আমাদের নেতা আর আমলাদের হুশ ফিরে পাওয়ার জন্য।  ক্ষমতায় থাকলে চারপাশের সব কিছু তারা নিজেদের ভাবেন আর করে নিতে তৎপর থাকেন।  সরকারের প্রায় আমলারা স্বপ্ন দেখেন আমলাগিরি ছেড়ে রাজনীতিতে নামবেন।  নিজের এলাকার উন্নয়নে নামেন চাকরির শেষ দিকে এসে।  যেন তারা সরকারি টাকায় নয়, নিজের কিংবা বাবার টাকায় ওই এলাকার উন্নয়ন করছেন।

রমজানের ইফতার সংস্কৃতি নিয়ে আগেও একদিন লিখেছিলাম -বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওয়েস্টিন, রেডিসন আর সোনারগাঁও হোটেলের ইফতার পার্টি দেওয়া গরিবের ঘোড়া রোগের মতই।  যে দেশে এখনও লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা, কারও কারও দুই বেলা খাওয়ারও নেই, সেই দেশে ধর্মের নামে এই জৌলুস আমদানি অপচয়, বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছু মনে হয় না।  এই জৌলুস, বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি কখনও আমাদের জন্য সুখকর হবে না।  আল্লার দরবারেরও সমাদৃত হতে পারে না।  দুর্নীতি আর রাজনীতি একাকার হয়ে গেছে এসব কারণেই। কর্মীদেরকে ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেওয়ার কোনও ব্যবস্থাই নেই আজকের রাজনীতিতে।  বরং ইফতারও রাজনীতিবিদদের, কর্মীদের চাঁদাবাজির আরেকটি মওসুম, আরেকটি উপলক্ষ, আরেকটি লোক দেখানোর কাজ।  এই উপলক্ষ ধর্মকে ব্যবহার করে অদূর ভবিষ্যতেও হবে।

আওয়ামী লীগ এখন সরকারের আছে।  প্রধানমন্ত্রী গণভবনে ইফতার পার্টি চালিয়েছেন বরাবরের মতো।  প্রধানমন্ত্রী গণভবনে একদিন এক শ্রেণির লোকদের নিয়ে ইফতার করেছেন, বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতিও ইফতারের বড় আয়োজন করেছিলেন।  অবশ্য এসব আয়োজনে কারা দাওয়াত পায় সেটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে থাকে।  সরকারি দলের লোক আর সমর্থকদের ছাড়া বাকিদের সেখানে দেখা পাওয়া কঠিন।  অথচ প্রতিষ্ঠান দুটি সার্বজনিন, কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের নয়।

আবার সরকারি দলের কারা দাওয়াত পায় সেটাও আরেকটা গবেষণার বিষয়।  বিশেষ করে রাষ্ট্রপতির পার্টিগুলোতে বঙ্গভবনে কারা দাওয়াত পায় সেটা নিয়ে তদন্ত করা দরকার। রাষ্ট্রপতির প্রেস সংক্রান্ত পাইক-পেয়াদাদের এটা দেখার কথা থাকলেও তারা নাকি দেখে না।  তাহলে একটি অলঙ্কারিক পদের প্রধানের এতো কর্মকর্তা-কর্মচারির কি দরকার! তার জনসংযোগ শাখা যখন জানে না দাওয়াতির লিস্ট করে কারা-- তাহলে এই শাখা রাখার কি দরকার!

রমজান শেষে ঈদ করার জন্য রাজনীতিবিদরা এখন নিজস্ব নির্বাচনি এলাকায়।  সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন তারা জাকাতের কাপড়।  নেতা কর্মীদের জন্য পাঞ্জাবি।  এবার নাকি লক্ষ লক্ষ পাঞ্জাবি বিক্রি হয়েছে।  গয়েশ্বর রায়ও কিনেছেন হাজার খানেক পাঞ্জাবি তার কর্মী- সুভানুধ্যায়ীদের জন্য।  নেতারা এখনও ভোটারদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ আর এলাকার রাজনীতি পরিচর্চা করছেন।  এই চর্চার পর পর আমরা দেখতে পাবো সারা দেশে আরও কিছু রাজনৈতিক হানাহানির খবর এবং বেশিরভাগই সেটা হবে নিজ দলের নেতা কর্মীদের মধ্যে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

anisalamgir@gmail.com